আওয়ামী লীগ নেতা ঠিক করেন, কে পানি পাবে!

মিরপুরে মদিনানগর হাউজিং এলাকায় ওয়াসার গাড়ি থেকে বাড়তি দামে পানি সংগ্রহ করতে হয় বাসিন্দাদের।  ছবি: প্রথম আলো
মিরপুরে মদিনানগর হাউজিং এলাকায় ওয়াসার গাড়ি থেকে বাড়তি দামে পানি সংগ্রহ করতে হয় বাসিন্দাদের। ছবি: প্রথম আলো

প্রায় চার মাস ধরে তীব্র পানিসংকট চলছে মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের মদিনানগর হাউজিং এলাকায়। এর মধ্যে এই আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা ওয়াসার আঞ্চলিক কার্যালয়ে (মডস জোন–১০) যতবার অভিযোগ নিয়ে গেছেন, ততবার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে ‘ম্যানেজ’ করে বিষয়টি সুরাহা করার পরামর্শ দিয়েছেন। এখন সেই নেতাই নির্ধারণ করছেন, কারা পানি পাবে আর কারা পাবে না। 

বাসিন্দাদের হিসাবে, মদিনানগর হাউজিং এলাকার ৬৪টি ভবনে হাজারখানেক পরিবার বসবাস করে। সব মিলিয়ে লোকসংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। দিনের পর দিন পাইপলাইনের পানি না পেয়ে তাঁরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। দৈনন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছেন ওয়াসার গাড়ি থেকে কেনা পানি দিয়ে। তা–ও কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে। নির্ধারিত মূল্য অনুসারে ওয়াসার ছোট এক গাড়ি পানির দাম ৪০০ টাকা। বাসিন্দারা তা কিনছেন ৬০০ টাকা করে। এ জন্য তাঁদের কোনো রসিদ দেওয়া হচ্ছে না।

ভবনমালিকেরা বলছেন, বর্তমানে প্রতি ৩৬ ঘণ্টা পরপর মদিনানগর হাউজিংয়ে তিন ঘণ্টার জন্য পানি আসে। তবু তাঁদের চার–পাঁচ হাজার টাকা করে মাসিক বিল পরিশোধ করতে হয়। প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে একটা ভবনে অন্তত দুই গাড়ি করে পানি লাগে। সে হিসাবে ভবনমালিকদের পানির পেছনেই মাসিক বাড়তি খরচ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার টাকার বেশি। এ ছাড়া সংকটের কারণে অনেক ভাড়াটে এই আবাসিক এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আর যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে পানি নিয়ে ভবনমালিকদের ঝগড়াঝাঁটি একটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

স্থানীয় ওয়াসা কার্যালয়ের কর্মীরা জানান, পানির স্তর নেমে যাওয়া এবং পাম্পের সক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে পানির সংকট প্রকট হয়েছে কয়েক মাসে। গতকাল বুধবার সকালে মদিনানগর হাউজিং মসজিদের সামনে এ বিষয়ে কথা হচ্ছিল এই আবাসিক এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা ও ভবনমালিকের সঙ্গে। কথোপকথনের একপর্যায়ে সেখানে অনেক মানুষের ভিড় জমে যায়। তাঁদের অভিযোগ, ছয় মাস আগে এই আবাসিক এলাকায় পানির সংকট ছিল না বললেই চলে। সংকট শুরুর পর থেকে তাঁরা মোট নয়বার ওয়াসার আঞ্চলিক কার্যালয়ে অভিযোগ নিয়ে গেছেন। কিন্তু কোনো ফল আসেনি। বরং মডস জোন–১০–এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ আশরাফুল হাবিব চৌধুরী তাঁদের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. আমান উল্লাহ আমানকে ‘ম্যানেজ’ করার পরামর্শ দেন। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলামও একই কথা বলেন। 

আজম খান নামের এক ভবনমালিক বলেন, ‘এখন আমান উল্লাহ আমাদের ২৪ নম্বর লাইনের পানি আটকে রাখেন। বলে যুদ্ধ হইলেও পানি দিমু না।’ ৩ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি শফিকুর রহমান আমান উল্লাহর উদ্দেশে বলেন, ‘সে (আমান উল্লাহ) এমপি না, কাউন্সিলর না, প্রশাসনের কেউ না। তাইলে সে পানি দেওয়া–নেওয়ার কে?’ 

লাইলী বেগম নামের আরেক ভবনমালিকের ভাষ্য, ‘পানি ছাড়া জান যায় যায় অবস্থা। ভাড়াটেরা চইল্যা যাইতেছে। আবার পানি না পাইলেও প্রতি মাসে ওয়াসারে চার–পাঁচ হাজার ট্যাকা বিল দিতে হয়। দুই গাড়ি পানি কিনতে হয় ১ হাজার ২০০ ট্যাকায়। তা–ও পাওয়া যায় না।’ 

ওয়াসার পানির গাড়ির জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় দিনভর।  ছবি: প্রথম আলো
ওয়াসার পানির গাড়ির জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় দিনভর। ছবি: প্রথম আলো

ওয়াসার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে কোহিনূর আক্তার নামের এক নারী বলেন, ‘দিনের পর দিন লাইনের পানি নাই। যদি বিল নিয়্যা কথা বলি, তাইলে পরের মাসে বিল আরও বাইড়্যা যায়। পানির গাড়ি আসে না। এইটা কি মগের মুলুক?’ 

বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার সময় ওয়াসার একটা গাড়ি আসে এখানকার একটা ভবনে পানি দেওয়ার জন্য। ছোট আকারের এক গাড়ি পানির জন্য গাড়ির চালক দুলাল ভবনমালিকের কাছ থেকে ৬০০ টাকা নেন। বাড়তি টাকা নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবাই তো খুশি হইয়াই দেয়। জোরাজুরি নাই।’ এ সময় ভবনমালিককে কোনো রসিদও দেননি তিনি। 

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মডস জোন–১০–এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ আশরাফুল হাবিব চৌধুরীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি বলেন, ‘এলাকায় (মদিনানগর হাউজিং) পানির কিছু সমস্যা ছিল। বিকেলেই ঠিক হয়ে গেছে।’ এ সময় বাসিন্দাদের অভিযোগ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি তৎক্ষণাৎ ফোন কেটে দেন। পরে আর ফোন ধরেননি। 

আর পানি আটকে রাখার অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, সেই আওয়ামী লীগ নেতা আমান উল্লাহ বলেন, ‘পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে শুধু মদিনানগর হাউজিং না, আশপাশের অনেক এলাকায় পানির সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাই রেশনিং পদ্ধতিতে পানি দেওয়া হয়। এলাকার সবাই যেহেতু আমারে মানে, তাই এক্সইএন সাহেব আমারে দায়িত্ব দিছিলেন কে কখন পানি পাবে, সেইটা ঠিক করতে।’ তবে মদিনানগর হাউজিংয়ের পানির লাইন আটকে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। 

বিষয়টি নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় কথা হয় ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের সঙ্গে। সব শুনে তিনি বলেন, ‘যদি এমন কিছু হয়, তাহলে সেটা ভয়াবহ ব্যাপার। আমি এক্ষুনি খোঁজ নিচ্ছি।’