রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কিছুটা কঠোর হচ্ছে সরকার

নাগরিকত্বসহ পাঁচ দফা দাবিতে অনড় থাকায় ২২ আগস্ট একজন রোহিঙ্গাকেও রাখাইনে পাঠানো যায়নি। রোহিঙ্গাদের এসব দাবির পাশাপাশি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত বিভিন্ন পক্ষের নানামুখী কর্মকাণ্ড, মুঠোফোনের যথেচ্ছ ব্যবহারসহ নানা কারণ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা হিসেবে কাজ করেছে। এই প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠানোর সমন্বিত কৌশলের অংশ হিসেবে প্রত্যাবাসনবিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, শিবিরে নিরাপত্তা জোরদারসহ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সভায় প্রত্যাবাসনের সব শেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে নানা বিষয় সামনে এসেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সভাপতিত্বে তাঁর দপ্তরে ২৮ আগস্ট এই টাস্কফোর্সের সভা হয়।

বৈঠকে অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাখাইন থেকে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের দুই বছর পেরিয়ে গেছে। এখন তাদের ব্যাপারে কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে বলে বাংলাদেশ সরকার মনে করছে। পরপর দুবার তারিখ ঘোষণার পরও প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় রোহিঙ্গাদের সহায়তায় যুক্ত সাহায্য সংস্থাগুলোর (এনজিও) কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তাই এসব এনজিওর ওপর নজরদারি বাড়ানো হবে।

এদিকে গত বছরের ১৫ নভেম্বরের পর এবার ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন শুরুর কথা থাকলেও তা হয়নি। এ অভিজ্ঞতা থেকে সরকার রোহিঙ্গাদের মতামত নেওয়ার প্রক্রিয়াটাকে আগে থেকেই শেষ করতে চায়। এর পাশাপাশি প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের কাছে নতুন করে ৫০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।

ওই দিনের বৈঠকে ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন কেন শুরু করা গেল না, ভবিষ্যতের পদক্ষেপ কী হবে, এর পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিবিরের ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি, ২৫ আগস্টের রোহিঙ্গা সমাবেশের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

গত ২৫ আগস্ট কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সমাবেশের পর সরকার বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। ভবিষ্যতেও বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত মঙ্গলবার তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা অনেক কিছু আলোচনা করেছি। অনেক বিষয়ে কথা বলেছি। আমরা চাই পরিস্থিতির উন্নতি হোক। আমাদের উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা। সে ব্যাপারে কেউ বাধা দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

দুটি এনজিওর কার্যক্রম বন্ধ

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনবিরোধী তৎপরতায় আর্থিক সহায়তা এবং উসকানি দেওয়ার অভিযোগে দুটি এনজিও আদ্রা ও আল মারকাজুল ইসলামীর কক্সবাজারের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই সংস্থা দুটির ব্যাংক হিসাব বা আর্থিক লেনদেন স্থগিত করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল এনজিওবিষয়ক ব্যুরো থেকে তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

>

রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সভা
প্রত্যাবাসনের সব শেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা
কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে
এবার ৫০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দেওয়া হবে

 

দুটি এনজিওই বাংলাদেশে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং শরণার্থীদের সহায়তামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এনজিও ব্যুরোর মহাপরিচালক কে এম আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে ওই দুটি এনজিওর কার্যক্রম কক্সবাজারে বন্ধ করা হয়েছে। আরও তদন্ত চলছে। সারা দেশে তাদের কার্যক্রম বন্ধ হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে।

কয়েক দিন আগে মুক্তি-কক্সবাজার নামে একটি এনজিওর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছিল। এর আগে আরও ছয়টি এনজিওর কর্মকাণ্ড সরকার বন্ধ করে দেয়।

অপরাধ বেড়ে চলেছে

জাতীয় টাস্কফোর্সের বৈঠকে মাঠ প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বেশ কিছু গোষ্ঠী প্রত্যাবাসনে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি রাখাইনে ফিরে যেতে আগ্রহী লোকজনকে হুমকি দিচ্ছে। এসব গোষ্ঠী অপরাধ করে দিব্যি পাহাড়ি এলাকায় গা ঢাকা দেয়।

বৈঠকে পুলিশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ২০১৭ সালে ৭৬টি মামলায় ১৫৯ রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি বেড়ে যথাক্রমে ২০৮ ও ৪১৪ হয়েছে। এ বছরের প্রথম ৭ মাসে ১৮৭টি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ৫১৫ জনকে।

গত দুই বছরে রোহিঙ্গাদের আর্থিক অবস্থা চোখে পড়ার মতো ভালো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন আরেক কর্মকর্তা। আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল হয়ে ওঠা রোহিঙ্গারা শিবিরের ভেতর একাধিক দোকান দিয়েছে। হাতে তাদের একাধিক মুঠোফোন। কেউ কেউ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা নিচ্ছে। ইন্টারনেট সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে মাত্র তিন দিনের প্রস্তুতিতে ২৫ আগস্টের সমাবেশটি করা হয়েছে।

পরে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ প্রতিহত করতে জেলার আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটির নির্দেশে গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একসঙ্গে কাজ করবে।

টাস্কফোর্সের বৈঠকে অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের একজন মন্তব্য করেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণসহ শিবিরের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আগের কিছু সিদ্ধান্ত ছিল। সেগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি। যেমন শিবিরে এনজিওর যেসব বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন, তাঁদের পাসপোর্ট বা ভিসা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। শিবিরের ভেতর কোনো দোকান থাকবে না, লোকজনকে নগদ টাকা না দেওয়ারও নির্দেশনা ছিল। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, এসব সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

চলতে থাকবে প্রস্তুতি

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনসহ এ সমস্যা সমাধানে টাস্কফোর্সের বৈঠকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রত্যাবাসনের নির্দিষ্ট কোনো তারিখের জন্য অপেক্ষা না করেই রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়ার প্রক্রিয়া গোপনে অব্যাহত রাখা হবে। প্রত্যাবাসনের জন্য খুব শিগগির মিয়ানমারের কাছে ৫০ হাজার রোহিঙ্গার একটি নতুন তালিকা পাঠানো হবে। আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি চলতে থাকবে। তবে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া যাতে ব্যর্থ না হয়, সে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ রাখা হবে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মুঠোফোনের অবাধ ব্যবহার বড় ভূমিকা রেখেছে বলে সরকারি কর্মকর্তারা মনে করেন। এই প্রেক্ষাপটে বৈঠকে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মুঠোফোনের ব্যান্ডউইডথ টু-জিতে নামিয়ে আনা এবং কঠোর আইন অনুসরণ করে মুঠোফোন ও সিম কার্ড বিক্রি নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি যেসব এনজিও বাংলাদেশের আইন ও স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ প্রতিহত করার লক্ষ্যে জেলার আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটির নির্দেশে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একসঙ্গে কাজ করবে।