জাপার দুর্গ কবজায় নিতে চায় আওয়ামী লীগ

রংপুর সদরের সংসদীয় আসনটি প্রায় ৩০ বছর ধরে এইচ এম এরশাদ বা জাতীয় পার্টির (জাপা) দখলে। যেটাকে মূল ধরে বৃহত্তর রংপুরকে তাদের দুর্গ বলে আসছিলেন দলটির নেতারা। এবার সেই ‘দুর্গের’ মূল জায়গাটি কবজায় নিতে কট্টর অবস্থান নিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ

ক্ষমতাসীন এই দলের স্থানীয় নেতারা বলছেন, এখন আর এরশাদ নেই। আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার চালাচ্ছে। তার ওপর এরশাদ পরিবার ও জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত। সব মিলিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা ১৯৭৩ সালের পর আর ফিরে না পাওয়া এই আসন পুনরুদ্ধারের সুবর্ণ সুযোগ মনে করছেন। তাই আসনটি নিয়ে মিত্রশক্তি জাতীয় পার্টির সঙ্গে আর কোনো সমঝোতায় না যেতে কেন্দ্রের ওপর চাপও রাখছেন রংপুরের নেতারা। 

এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের স্থানীয় ১৬ জন নেতা দলীয় মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। অতীতে এ আসনে এত মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন না। তা ছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে এখন জাতীয় পার্টি বা জোট শরিকদের গুরুত্ব দেওয়া কমে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের এমন আচরণ ও মনোভাবের আঁচ পেয়েছেন স্থানীয় নেতারাও। এতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের উৎসাহ বেড়েছে।

মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অন্যতম রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী সবাই আশাবাদী যে যিনি নৌকা প্রতীক পাবেন তিনিই জিতবেন।

অবশ্য এত প্রার্থীর মনোনয়নপ্রত্যাশার বিষয়টিকে কেন্দ্রের ওপর একধরনের চাপ হিসেবে দেখছেন রংপুরের প্রবীণ রাজনীতিক ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক গণতন্ত্রী পার্টির রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি আরশাদ হারুন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত বেশি মনোনয়ন–প্রার্থিতার ভালোমন্দ দুটো দিক আছে। আমার মনে হয়, এটি কেন্দ্রের ওপর স্থানীয় চাপ। তা ছাড়া নতুন করে জাতীয় পার্টির বিভক্তি আওয়ামী লীগকে আরও সুবিধা করে দিল।’

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা মনে করেন, এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়বে। তা ছাড়া, বারবার এই দলটিকে ছাড় দিতে গেলে আওয়ামী লীগ স্থানীয়ভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তে পারে এবং এই সুযোগে বিএনপির উত্থান ঘটতে পারে।

এ বিষয়ে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক আগেই জাতীয় পার্টি শেষ হয়ে যেত, আওয়ামী লীগ বাঁচিয়ে রেখেছে। এখন আর জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেওয়ার কোনো কারণ নেই। লং রান দলটি থাকবে না।’ 

>আসনটি প্রায় ৩০ বছর ধরে জাপার দখলে
আসন পুনরুদ্ধারের সুযোগ দেখছেন আ.লীগ
আ.লীগের মনোনয়ন চান ১৬ জন
জাপা নেতৃত্ব বিভক্ত, মনোনয়ন চান পাঁচজন
বিএনপিতেও পাঁচজন মনোনয়নপ্রত্যাশী


এরই মধ্যে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদ এবং রংপুর উপনির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও সিনিয়র কো–চেয়ারম্যান রওশন এরশাদকে ঘিরে দলে বিভক্তি ঘটেছে। দলের একাংশ গতকাল রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছে। এতে রংপুরসহ সারা দেশে দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা বিব্রত।

অবশ্য রংপুর উপনির্বাচনে জাপার অন্যতম মনোনয়নপ্রত্যাশী এবং দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফখর-উজ–জামান মনে করেন, এই পরিস্থিতি সাময়িক। মান-অভিমান ভেঙে যাবে। তিনি বলেন, এরশাদের জাতীয় পার্টি বলতে এখন মাঠপর্যায়ের কর্মী-সমর্থকেরা জি এম কাদের ও তাঁর অনুসারীদেরই বোঝেন।

জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আকস্মিক এই বিভক্তি আওয়ামী লীগের রংপুরের নেতাদের জন্য স্বস্তির কারণ হয়ে এলেও তাঁরা বিষয়টি প্রকাশ্যে বলতে চাইছেন না। বরং সম্ভাব্য প্রার্থীরা রংপুরের উন্নয়নবঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি সামনে আনছেন। 

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর কেন্দ্রীয় সদস্য ও মনোনয়নপ্রত্যাশী চৌধুরী খালেকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ এগোচ্ছে কিন্তু রংপুর এগোচ্ছে না। আমরা বারবার আসনটি ছাড়ছি। এতে মহাজোট উপকৃত হচ্ছে কিন্তু রংপুরবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের মৃত্যুতে রংপুর-৩ আসনটি শূন্য হয়। ১৯৯১ সাল থেকে তিনি এই আসনে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। আগামী ৫ অক্টোবর এখানে ভোট হবে। এরই মধ্যে জাতীয় পার্টি থেকে পাঁচজন, আওয়ামী লীগ থেকে ১৬ জন, বিএনপি থেকে পাঁচজন দলের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। 

গতকাল রংপুর শহরে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার অনেকের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা মনে করেন, রংপুরে এরশাদের আবেগ এখনো জীবন্ত; তাঁর লাঙ্গল প্রতীক এখনো জনপ্রিয়। সমঝোতা না হলে লাঙ্গল প্রতীকের প্রতিদ্বন্দ্বী হবে নৌকা। আবার কেউ কেউ গত সংসদ নির্বাচনে এরশাদের সঙ্গে ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রিটা রহমানের পাওয়া ৫৩ হাজার ভোট দেখে এ-ও বলেছেন, লাঙ্গল-নৌকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ পর্যন্ত ধানের শীষেও গড়াতে পারে। 

জাপার উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, রংপুরের উপনির্বাচন তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এরশাদের আসনটি আওয়ামী লীগের ছাড় দেওয়া না–দেওয়া এবং শেষ পর্যন্ত এখানে জাপার প্রার্থী কে হন, তার ওপর জাপার ভবিষ্যৎ রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করছে।