পৌনে তিন কোটি টাকার সার লোপাট

বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) বগুড়া বাফার গুদামের পৌনে ৩ কোটি টাকার সারের হদিস নেই। গুদামের কর্মকর্তাকে (ইনচার্জ) দায়িত্বভার বুঝিয়ে দেওয়া নিয়ে জটিলতাকে কেন্দ্র করে বিসিআইসির এক তদন্ত প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।

দেশে কৃষকদের জন্য সার উৎপাদনের পাশাপাশি ঘাটতি পূরণে সার আমদানি করে বিসিআইসি। এসব সার যেসব গুদামে আপৎকালীন মজুত করা হয়, তাকে বাফার গুদাম বলে। দেশের ২৪টি বাফার গুদামের একটি বগুড়ার তিনমাথা এলাকায় অবস্থিত। এর ধারণক্ষমতা ১২ হাজার মেট্রিক টন। বগুড়ার সার নিয়ে আসা হয় সাধারণত সাউথ ডেলটা ট্রেডার্স, পোটন ট্রেডার্স, নওয়াব ট্রেডার্সসহ বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। নিয়ম অনুয়ায়ী, পরিবহন ঠিকাদার সার সম্পূর্ণভাবে বুঝিয়ে দিলে গুদামের ইনচার্জ একটি রসিদ দেবেন। সেই রসিদ দেখিয়ে ঠিকাদারেরা তাঁদের প্রাপ্ত টাকা বুঝে নেবেন। পরে বগুড়া গুদাম থেকে বিভিন্ন এলাকায় সার সরবরাহ করা হয়।

২০১৮ সাল থেকে বগুড়া বাফার গুদামের ইনচার্জ ছিলেন ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো. আনোয়ার হোসেন। গুদামের দ্বিতীয় শীর্ষ পদ কারিগরি কর্মকর্তা (উৎপাদন) ছিলেন মো. নাজমুল ইসলাম ভূঁইয়া। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি এই দুই কর্মকর্তাকে বগুড়া বাফার গুদাম থেকে বদলি করা হয়। আনোয়ার হোসেন যান বগুড়ায় অবস্থিত উত্তরাঞ্চলীয় বাফার নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) পদে। আর নাজমুল ইসলামকে যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের (জেএফসিএল) বাণিজ্যিক/বিক্রয় শাখায় বদলি করা হয়।

বাফার গুদাম সূত্রে জানা গেছে, এই বদলির পর নতুন কর্মকর্তার দায়িত্ব গ্রহণের সময়ই পৌনে ৩ কোটি টাকার সার জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। আনোয়ার হোসেনকে সরানোর পর বাফার গুদামের ইনচার্জ করা হয় ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) আকতারুল ইসলামকে। তিনি দায়িত্ব নিতে গিয়ে দেখতে পান, গুদামের সারের টাকা ব্যাংকে জমা পড়েনি। জেএফসিএলের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) ওয়ায়েছুর রহমান বিষয়টি খতিয়ে দেখা শুরু করেন। 

বিষয়টি বিসিআইসির প্রধান কার্যালয়ের নজরে আসে। সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মো. মঞ্জুর রেজা জেএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, বগুড়া বাফার গুদামের নিবন্ধনে সারের হিসাবের গরমিল রয়েছে। ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে গুদামের হিসাবের অমিল ও গুদামের সরবরাহ করা পরিবহন ঠিকাদারদের সারের অনিয়ম বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। চিঠি পাওয়ার পর জেএফসিএল তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় জেএফসিএলের উপপ্রধান হিসাবরক্ষক দুলাল উদ্দিনকে। 

প্রায় ১৫ দিন বগুড়ায় অবস্থান করে এই তদন্ত কমিটি। তারা গত ৪ আগস্ট জেএফসিএল কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২৩৯ মেট্রিক টন সার বগুড়া বাফার গুদাম থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। অথচ ওই সারের টাকা ব্যাংকে জমা পড়েনি। ওই সারের মূল্য ৩৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। আবার বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আসা ১ হাজার ৭৯৩ দশমিক ৬৩ মেট্রিক টন সার গুদামজাত করার অনুপযোগী ছিল। কারণ, এই সারের বস্তা ছেঁড়াফাটা ছিল। এই বস্তাগুলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পুনরায় বস্তাভর্তি করে দেওয়া কথা। কিন্তু বাস্তবে গুদামে ওই সারের কোনো অস্তিত্ব নেই। অথচ টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। এই সারের মূল্য ২ কোটি ৫১ লাখ ১০ হাজার ৮২০ টাকা।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক দুলাল উদ্দিন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের তদন্তে গুদামের ২৩৯ মেট্রিক টন সারের অনিয়ম ও ১ হাজার ৭৯৩ দশমিক ৬৩ মেট্রিক টন সার লোপাটের প্রমাণ মিলেছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুদামের কর্মকর্তারা জড়িত। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুদামের ২৩৯ মেট্রিক টন সারের অনিয়মের ক্ষেত্রে তৎকালীন গুদাম ইনচার্জ আনোয়ার হোসেন এবং কারিগরি কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম সমানভাবে দায়ী। আর ১ হাজার ৭৯৩ দশমিক ৬৩ মেট্রিক টন সার লোপাট হয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা ও কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে। 

তবে নাজমুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি এক বছর হলো বগুড়া বাফার গুদাম থেকে চলে এসেছি। আমি এগুলোর সঙ্গে নেই।’

আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুদামের ২৩৯ মেট্রিক টন সার ভুলে হয়তো কারও কাছে গেছে। বিষয়টি নিয়ে আমি কাজ করছি। এর মধ্যে কিছু সারের খবর পাওয়া গেছে। আর অন্য সারের বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। বিষয়টি তদন্ত হচ্ছে। আরও তদন্ত কমিটি গঠন হবে।’

জানতে চাইলে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. হাইয়ুল কাইয়ুম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুদামে সারের অনিয়মের বিষয়টি আমরা জানি। ওই কর্মকর্তা আঞ্চলিক কার্যালয়ে থাকুন বা বাফার গুদামে থাকুন, এটা কোনো বিষয় নয়। পক্ষপাতিত্বের কোনো সুযোগ নেই। দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’