প্রবাসে শ্রমিকের ৬২% মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

কুমিল্লার মো. তাজুল ইসলাম (৩১) প্রায় আট বছর আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ছিলেন। ভবনে অ্যালুমিনিয়ামের পাত লাগানোর কাজ করতেন। অবশ্য নিয়োগকারী এজেন্সি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় কাজও দিত তাঁকে। দুই বছরের মধ্যেই উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয় তাঁর। এরপর প্রতিবছর দেশে ফিরে চিকিৎসা করাতেন। কাজের চাপে টানা ২২ মাস দেশে ফেরেননি। তাঁর ভাই বোরহান জানান, গত ১২ জুন স্ট্রোক করে সেখানকার এক হাসপাতালে মারা যান তাজুল।

সুনামগঞ্জের আনিছ আলী (৩৬) সৌদি আরবে ভবনে কাজ করতেন। তেমন কোনো অসুস্থতার কথা জানা নেই তাঁর পরিবারের। দেশে ফিরেও কখনো চিকিৎসা নিতে দেখা যায়নি তাঁকে। তাঁর স্ত্রী শাপলা আক্তার বলেন, ‘২২ মে সকাল আটটায়ও কথা বলছি, দুপুর দুইটায় আর ফোন করে পাইনি। পরে শুনেছি, স্ট্রোক করে মারা গেছেন।’

প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর তথ্য সংরক্ষণ করে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ জন শ্রমিকের লাশ আসছে। এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে এসেছে ২ হাজার ৬১১টি লাশ। এর মধ্যে প্রথম ছয় মাসের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশই মারা গেছেন স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে। এরপর দুর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় ১৮ শতাংশ। আর স্বাভাবিক মৃত্যু ৫ শতাংশ।

মৃত ব্যক্তিদের স্বজন, প্রবাসী বাংলাদেশি ও অভিবাসন খাত-সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ অভিবাসন ব্যয় প্রবাসীদের মানসিক চাপ বাড়ানোর অন্যতম কারণ। ঋণ নিয়ে বিদেশে গিয়ে টাকা শোধ করার চাপের কারণে অতিরিক্ত কাজ করার প্রবণতা রয়েছে শ্রমিকদের মধ্যে। ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করার কারণে নিয়মিত ঘুমানোর সুযোগ পান না শ্রমিকেরা। এসব কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। অথচ বাংলাদেশে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসে। দ্বিতীয় বৈদেশিক আয়ের এ খাতে সরকারের তেমন কোনো বিনিয়োগ নেই। প্রবাসীদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে দূতাবাসগুলোর জনবল ঘাটতির কথা বলা হয় প্রায়ই।

অভিযোগ রয়েছে, প্রবাসীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু তদন্তে কোনো উদ্যাগ নেই সরকারের। মৃত্যুর কারণ যাচাই-বাছাই করে দেখা হয় না। প্রবাসী কর্মীদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও নেই কোনো নজরদারি। বছরের পর বছর অস্বাভাবিক মৃত্যু বাড়তে থাকলেও তা প্রতিরোধে সক্রিয় হচ্ছে না সরকার।

এ বিষয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব রৌনক জাহান প্রথম আলোকে বলেন, এমন মৃত্যুর বিষয়টি তাঁদেরও নজরে এসেছে। অধিকাংশ প্রবাসী পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না। ভালো করে প্রস্তুতি না নিয়ে, কখনো দায়সারা প্রশিক্ষণ নিয়ে চলে যান। ভিন্ন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে যথাযথ প্রস্তুতির বিষয়টি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যুক্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রবাসীদের সচেতন করতে দেশজুড়ে কর্মসূচি চলমান আছে।

>

ঋণ নিয়ে বিদেশে গিয়ে টাকা শোধ করার চাপের কারণে বাড়তি কাজের প্রবণতা
মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখে না সরকার

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড বলছে, লাশ হয়ে ফেরা প্রবাসীদের ৮০ শতাংশের বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে, যার অধিকাংশই মূলত সৌদি আরবের। গত ২৬ মার্চ সৌদি আরবের জেদ্দা কনস্যুলেট প্রবাসীদের জন্য বিনা পয়সায় চিকিৎসাসেবা দিয়েছিল। এতে ৬১৬ জন প্রবাসী কর্মী চিকিৎসা সহায়তা নেন। এর মধ্যে ৯৪ শতাংশ (৫৮১ জন) প্রবাসীর উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়।

অতিরিক্ত কাজের চাপ, অতিরিক্ত তাপমাত্রা, উচ্চ ক্যালরির খাবার, ব্যায়াম না করার প্রবণতা প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর চাপ তৈরি করছে বলে মনে করেন কনস্যুলেটের শ্রম বিভাগের কাউন্সেলর মো. আমিনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসে কেউ মারা গেলে লাশ দেশে নেওয়া বা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত দেন পরিবারের লোকজন। অনেকে এখানেও সমাহিত করার কথা বলেন। তবে প্রবাসীর মৃত্যুর পর স্থানীয় হাসপাতাল থেকে ডেথ নোটিফিকেশন দূতাবাসে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক, সেখানে মৃত্যুর কারণ লেখা থাকে। এসব কাগজপত্র লাশের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

প্রবাসে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে কেউ কেউ দেশের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সে চিকিৎসা নিতে আসেন বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির যুগ্ম পরিচালক মো. বদরুল আলম মণ্ডল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আক্রান্ত হওয়ার পরও সেখানে তাঁরা চিকিৎসা পান না, তাই দেশে চলে আসেন। শ্রমিকেরা চিকিৎসাহীন অবস্থায় বছরের পর বছর পার করে দেন। অতিরিক্ত কাজ, কম ঘুম, অস্বাস্থ্যকর খাবার, পুষ্টির অভাবে উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন তাঁরা। এ ছাড়া নানা চাপের কারণে ‘স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে’ ভোগেন প্রবাসী কর্মীরা।

জানা গেছে, গত আগস্টে বিভিন্ন দেশ থেকে লাশ হয়ে ফিরেছেন ২৯৪ জন। এর মধ্যে স্ট্রোকে সৌদি আরবে মারা গেছেন মৌলভীবাজারের শহিদুল মিয়া (২৭), মালয়েশিয়ায় সিরাজগঞ্জের আল আমিন (৩২), ওমানে লক্ষ্মীপুরের সুভাষ চন্দ্র দেবনাথ (৩৩), কাতারে টাঙ্গাইলের আশরাফ আলী (২৭), আরব আমিরাতে কিশোরগঞ্জের আরাফাত আলী (২৭), ইতালিতে শরীয়তপুরের মনির হোসেন (২৮), দক্ষিণ আফ্রিকায় কেরানীগঞ্জের লোকমান (৩৩) এবং সিঙ্গাপুরে মারা গেছেন চাঁদপুরের হোসেন আহমেদ (২৭)।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্যমতে, ২০০৫ সাল থেকে ধরলে গত আগস্ট পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৭৪৯ জনের লাশ এসেছে বিদেশ থেকে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪৮১, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৮৭ এবং ২০১৮ সালে আসে ৩ হাজার ৭৯৩টি মৃতদেহ। এর বাইরে বিদেশে অনেক প্রবাসীর দাফন হয়েছে। সেই সংখ্যা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জানা নেই। প্রবাসীদের এমন মৃত্যুর কারণ নিয়েও কখনো অনুসন্ধান করেনি মন্ত্রণালয়।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ জুলহাস প্রথম আলোকে বলেন, প্রয়োজন না পড়ায় মৃত্যুর কারণ কখনো যাচাই করে দেখা হয়নি। দূতাবাস থেকে পাঠানো প্রতিবেদন অনুসারেই মৃত্যুর কারণ নথিভুক্ত করা হয়। তবে বর্তমানে গত তিন বছরে প্রবাসী নারী কর্মীদের মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করে দেখছেন তাঁরা।

প্রবাসীদের উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ের জন্য বেসরকারি খাতের জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দায়ী করা হয়। সরকার ব্যয় নির্ধারণ করে দিলেও অনেক ক্ষেত্রে তা মানে না প্রতিষ্ঠানগুলো। এ বিষয়ে বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, চাপ সহ্য করার মতো প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে শ্রমিকদের। তারপরও নানা কারণে শ্রমিকের মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু বিমা সুবিধার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা জরুরি।

দীর্ঘদিন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় অভিবাসন নিয়ে কাজ করছেন আসিফ মুনীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশের অর্থনীতি সচল রাখা রেমিট্যান্সের কথা ভেবে হলেও প্রবাসীদের আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত সরকারের। দায়সারাভাবে তাঁদের পরিবারকে মৃত্যুর কারণ বলে দেওয়াটা খুব অসম্মানজনক। মৃত্যুর কারণ অবশ্যই সরকারিভাবে যাচাই করা এবং তা প্রতিরোধে উদ্যোগী হওয়া উচিত। বিদেশের কর্মপরিবেশ উন্নত করার জন্য দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় আলোচনার প্রয়োজন।