এরশাদ পরিবারে বিভক্তি, জাপার মাঠপর্যায়ে হতাশা

জাতীয় পার্টি
জাতীয় পার্টি

দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এরশাদ পরিবারে বিভক্তি। এর জের ধরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ভাগাভাগি জাতীয় পার্টির (জাপা) মাঠপর্যায়ের নেতা–কর্মীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে। এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর–৩ আসনে উপনির্বাচনের প্রাক্কালে উদ্ভূত এ পরিস্থিতি স্থানীয় কর্মী-সমর্থকদের উৎকণ্ঠায় ফেলেছে।

মাঠপর্যায়ের নেতা–কর্মীরা বলছেন, রংপুরের সদরের আসনটি দখলে নিতে একদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চাপ আছে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টিতে রয়েছে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে টানাপোড়েন। এর মধ্যে শীর্ষ নেতৃত্বের এই ​বিভক্তি সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের হতাশায় ফেলেছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে দলের একটি পক্ষ রওশন এরশাদকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করা নিয়ে এরশাদের নিজ জেলা রংপুরে বেশ প্রতিক্রিয়া আছে। গতকাল শুক্রবার রংপুরে রওশন এরশাদের বিরুদ্ধে ঝাড়ুমিছিল করেছে জাতীয় মহিলা পার্টি। আর ঢাকায় জাপার বনানীর কার্যালয়ের সামনে মিছিল হয়েছে দলের জ্যেষ্ঠ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও ফকরুল ইমামকে বহিষ্কারের দাবিতে। এই দুজন রওশন এরশাদকে বিভ্রান্ত করছেন বলে বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ।

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ গত ১৪ জুলাই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর দুই মাস পার হওয়ার আগেই দলটি ভাঙনের মুখে পড়েছে। এক পক্ষের নেতৃত্বে এরশাদের স্ত্রী ও দলের সিনিয়র কো–চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। আরেক পক্ষের নেতৃত্বে এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদের, যাঁকে এরশাদ জীবদ্দশায় তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী ঠিক করে গেছেন। কিন্তু রওশন এরশাদ ও তাঁর সমর্থক নেতারা কাদেরকে চেয়ারম্যান মানতে চান না।

জাপার নেতারা বলছেন, দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রওশন ও জি এম কাদেরের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তুষ্টির শুরু অনেক আগে থেকে চলে এলেও প্রকাশ্য বিভক্তির প্রকাশ ঘটে মূলত এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনের দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে। রওশন চান ছেলে সাদ এরশাদকে প্রার্থী করতে। এর মধ্য দিয়ে সাদকে জাপার রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠান করা রওশনের লক্ষ্য। জি এম কাদের তা চান না। এরশাদ পরিবারের এই বিরোধকে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের একটি অংশ ব্যবহার করেছেন, যাঁরা জি এম কাদেরকে পছন্দ করছিলেন না।

এ অবস্থায় রংপুরের উপনির্বাচনে এরশাদ পরিবারের কাউকে প্রার্থী না দিয়ে স্থানীয় প্রার্থীর দিকে মনোযোগী হয়েছেন জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব। গতকাল যে তিনজন মনোনয়ন প্রত্যাশী সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তাঁরা সবাই রংপুরের। তাঁদের মধ্যে জাপার রংপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসিরকে মনোনয়ন দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে দলের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, জাতীয় রাজনীতিতে জাপার অবস্থান ও শক্তি ক্রমেই কমে আসছে। এরশাদের মৃত্যুর পর দলটির টিকে থাকা নিয়ে অনেকের মনে সংশয় আছে।

যদিও রংপুর জাতীয় পার্টির নেতাদের অনেকে বলছেন, রওশন ও জি এম কাদেরের বিভক্তি অন্তত বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। কারণ এরশাদের অবর্তমানে ইতিমধ্যেই নেতা-কর্মী ও সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে জি এম কাদের দলের প্রধান নেতা হিসেবে অবস্থান ও সাংগঠনিক পরিচিতি পেয়ে গেছেন। 

এ বিষয়ে জাপার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও গাইবান্ধা জেলা কমিটির সভাপতি আবদুর রশীদ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলে ভাঙন হলেও রংপুরে এর প্রভাব পড়বে না। কারণ রংপুরের মানুষের কাছে জি এম কাদেরই এরশাদের উত্তরাধিকার। আর রংপুর মহানগর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জাহেদুল ইসলাম মনে করেন, শুধু লাঙ্গল নিয়ে আইনগতভাবে কোনো সমস্যা না হলেই হয়। 

জাপার নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সংসদীয় দল—উভয় ক্ষেত্রেই জি এম কাদেরের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আছে। ইতিমধ্যে জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা নিযুক্ত করার জন্য স্পিকারকে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, তাতে দলের ২৫ জন সাংসদের মধ্যে ১৫ জনের স্বাক্ষর করেছেন। স্বাক্ষরের বাইরে থাকা আরও তিনজন সাংসদ জি এম কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে জানা গেছে। আর গতকাল সন্ধ্যায় বনানীতে জি এম কাদেরের আহ্বানে যে জরুরি সভা হয়েছে, তাতে দলের ৫১ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের ৩৭ জন উপস্থিত ছিলেন।

মহাসচিব কার পক্ষে

রংপুরের বাসিন্দা জাপার মহাসচিব মসিউর রহমানের ভূমিকা নেতা-কর্মীদের জন্য রহস্য হয়ে আছে। তাঁকে কোনো পক্ষের​ সভায় দেখা যাচ্ছে না। জাপার কেন্দ্রীয় ও রংপুরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের মহাসচিব মসিউর রহমান দ্বৈত ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি আপাতত রওশন-জি এম কাদের—দুই পক্ষই সামলে চলছেন। রওশনের পক্ষের নেতারা বলেছেন তিনি তাঁদের সঙ্গে আছেন। এরশাদের চেহলাম অনুষ্ঠানে রওশন এরশাদ ও ছেলে সাদ এরশাদের রংপুরে আসার পেছনে মসিউর রহমানের উদ্যোগী ভূ​মিকা ছিল।

এ বিষয়ে গতকাল জি এম কাদেরের সভাপতিত্বে জাপার সভাপতিমণ্ডলীর সভা শেষে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন, মসিউর রহমান আসলে কোন পক্ষে। জবাবে দলের জ্যেষ্ঠ নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, তিনি কোন পক্ষে, তাঁকেই জিজ্ঞেস করুন না।

তবে মসিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। অসংখ্যবার তাঁর মুঠোফোনে কল দিলেও তিনি ধরেননি।