'স্বামীর জন্য শোক করব, নাকি ছেলেকে বাঁচাব'

তিন দিন আগে বাসচাপায় স্বামী হারিয়েছেন রুমানা সুলতানা। আর একই কোম্পানির বাসের চাপায় গুরুতর আহত ছেলে ইয়াসির আলভি এখন হাসপাতালের বিছানায়। গতকাল বিকেলে শ্যামলীর ট্রমা সেন্টারে।  ছবি: জাহিদুল করিম
তিন দিন আগে বাসচাপায় স্বামী হারিয়েছেন রুমানা সুলতানা। আর একই কোম্পানির বাসের চাপায় গুরুতর আহত ছেলে ইয়াসির আলভি এখন হাসপাতালের বিছানায়। গতকাল বিকেলে শ্যামলীর ট্রমা সেন্টারে। ছবি: জাহিদুল করিম

মাত্র তিন দিন আগে নির্মম সড়ক দুর্ঘটনা তাঁর স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে। স্বামীর মৃত্যুশোক সামলানোর অবকাশ পেতে না পেতেই ছেলে হয়েছেন আরেক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। ছেলে অনিশ্চিত সময় কাটাচ্ছে হাসপাতালের বিছানায়। স্বামীর শোক পেছনে ফেলে রুমানা সুলতানা এখন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কাতর। একই পরিবহনের বেপরোয়া বাস তাঁর স্বামী–সন্তানকে পিষ্ট করে তছনছ করে দিয়েছে তাঁর স্বাভাবিক জীবন।

‘ভিক্টর ক্ল্যাসিক’ পরিবহনের বাসের ধাক্কায় গত বৃহস্পতিবার প্রাণ হারিয়েছেন রুমানার স্বামী কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক পারভেজ রব। এক ছাত্রীকে গান শেখাতে সদরঘাটে যাওয়ার সময় উত্তরার ইস্টওয়েস্ট মেডিকেল কলেজের সামনে তিনি দুর্ঘটনার পড়েন। এর তিন দিনের মাথায় শনিবার রাতে উত্তরার কামারপাড়া এলাকায় একই পরিবহনের আরেকটি বাস চাপা দেয় তাঁর ছোট ছেলে ইয়াসির আলভী ও তাঁর বন্ধু মেহেদী হাসানকে। আলভি গুরুতর আহত হয়েছেন। কিন্তু চিরতরে হারিয়েছেন প্রাণের বন্ধু মেহেদীকে।

বাবা আর বন্ধুকে হারিয়ে শরীরের যন্ত্রণা ছাপিয়ে গেছে আলভীর মনের শোক। গতকাল আলভীর চিকিৎসা চলছিল রাজধানীর শ্যামলীর ট্রমা সেন্টারে।

ট্রমা সেন্টারের ষষ্ঠ তলায় পুরুষ ওয়ার্ডের সামনে রুমানা সুলতানাকে দেখাচ্ছিল ভাবলেশহীন। কান্নার অনুভূতি তাঁর চলে গেছে। দুই চোখ নিস্প্রভ। অবসন্ন কণ্ঠে শুধু বললেন, ‘আমি স্বামীর জন্য শোক করব, নাকি ছেলেকে বাঁচাব, কিছুই ভাবতে পারছি না।’

গতকাল ছিল স্বামী পারভেজ রবের কুলখানি হওয়ার কথা। কিন্তু স্বামী হারানোর শোক পেছনে ফেলে তিনি এখন ব্যাকুল হয়ে আছেন সন্তানকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার তাড়নায়। রুমানা বললেন, ‘ছেলের যে অবস্থা দেখছি, তাতে ও বেঁচে থাকলেও আর কখনো নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারবে কি না সন্দেহ।’

স্বামী ও সন্তানকে চাপা দেওয়া বাসচালক ও ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কঠোর বিচার দাবি করলেন রুমানা। বললেন, ‘আমি যা হারিয়েছি,তা তো কোটি টাকা দিলেও ফিরে আসবে না। তাই আমি কোনো ক্ষতিপূরণ চাই না। কারণ, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এইটা মার্ডার (হত্যাকাণ্ড)। আমি শুধু এর বিচার চাই।’

ইয়াসির আলভি উত্তরা টাউন কলেজের ইংরেজি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। গতকাল তাঁকে দেখা গেল হাসপাতালের বিছানায় অসহায় ভঙ্গিতে শুয়ে থাকতে। ডান হাতের উন্মুক্ত অংশে সড়কের পিচে ছেঁচড়ে যাওয়ার দাগ। বাঁ হাতে চলছে স্যালাইন। পেটের নিচ থেকে পা পর্যন্ত সাদা কাপড়ে ঢাকা। পাশে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ছিল ছোট বোন রামিসা ইবনাথ।

হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জন কামরুজ্জামান বলেন, ‘আলভীর কোমরের নিচের পেলভিস বোন ভেঙে গেছে। আরও নিশ্চিত হয়ে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এর বেশি কিছু এখন বলা সম্ভব হচ্ছে না।’

নিহত মেহেদী হাসান
নিহত মেহেদী হাসান

আলভির যখন চিকিৎসা চলছে, তখন উত্তরার তুরাগের ঈদগাহ মাঠে চলছিল মেহেদী হাসানের জানাজা। স্থানীয় এক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মেহেদীর বাসা তুরাগের ধউর এলাকায়। বাবা ইউসুফ আলী তুরাগে মোটরগাড়ির যন্ত্রপাতির ব্যবসা করেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে মেহেদি দ্বিতীয়। উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের কামারপাড়া কলেজ থেকে গত বছর এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হয়েছিলেন উত্তরা কমার্স কলেজে।

মুঠোফোনে কথা হলে মেহেদীর বাবা ইউসুফ আলী বলেন, ‘আমার সামান্য যন্ত্রপাতির ব্যবসা। দুই ছেলে ঘিরেই আমার যত আশাভরসা। মেহেদী চাইত পড়াশোনা শেষ করে ব্যাংকার হতে। সেই ছেলেকে বাসটি ইচ্ছাকৃতভাবে চাপা দিয়ে মারল।’

বাসচাপায় মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল রোববার উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেছেন মেহেদীর মামাতো ভাই মো. ফিরোজ। এজাহারের বর্ণনা বলছে, রাত নয়টা ৫০ মিনিটে উত্তরার স্লুইসগেট বাসস্ট্যান্ড এলাকা ও আবদুল্লাহপুরের মাঝামাঝি মেহেদী হাসান ও ইয়াসির আলভি সড়ক পার হওয়ার সময় ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহনের একটি বেপরোয়া গতির বাস (ঢাকা মেট্রো-ব, ১১-৮৬৭০) পেছন থেকে তাঁদের ধাক্কা দেয়। এতে তারা গুরুতর আহত হন। তাঁদের উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাত ১১টার দিকে চিকিৎসকেরা মেহেদীকে মৃত ঘোষণা করেন। বাসচাপার ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের বন্ধু রাসেল আহমেদ। তিনি বলেন, আলভির বাবার মৃত্যুর ঘটনায় বাস মালিকের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ছিল। সে টাকা নিতেই আলভি ও মেহেদী পাঁচ-ছয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ৯ নম্বর সেক্টরের হোয়াইট প্যালেস হোটেলের সামনে ভিক্টর পরিবহনের স্ট্যান্ডে যান। সেখানে বাস দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা দুজনের সঙ্গে তাঁদের কথা-কাটাকাটি হয়। সে সময়েই ভিক্টর পরিবহনের একটি বাস মেহেদী ও আলভিকে পাশে থাকা আরেক বাসের সঙ্গে চাপা দেয়। পরে পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে চালক রফিকুল ইসলামকে আটক করে। তবে তার আগেই চালকের সহকারী পালিয়ে যান।

গতকাল রোববার দুপুরে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে চালক রফিকুল ইসলামকে আদালতে হাজির করে উত্তরা পশ্চিম থানা-পুলিশ। আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। উত্তরা পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক মো. সাদেক বলেন, রিমান্ড শেষে ঘটনার মূল কারণ জানা যাবে।

মো. সাদেক বলেন, গ্রেপ্তারের সময় রফিকুলের কাছে থেকে লাইসেন্স ও গাড়ির কাগজ পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে আগেও ট্রাফিক আইন ভঙ্গের মামলা আছে। জব্দকৃত কাগজ বৈধ কি না, তা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সহায়তায় খতিয়ে দেখা হবে।

পারভেজের সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি তুরাগ থানা-পুলিশ। উপপরিদর্শক নির্মল চন্দ্র দেব বললেন, অপরাধীদের ধরার জন্য চেষ্টা চলছে।