'গাধা, তুই বোর্ডে ফিফথ হয়েছিস'

হেড স্যারের সামনে থরথর করে কাঁপছি, তিনিও কাঁপছেন, তবে রাগে। তাঁর হাতে বার্ষিক পরীক্ষার ফল। বোঝা যাচ্ছে আরেকটু হলে ‘ক্লাস এইট’ সেকেন্ড ইয়ার হয়ে যেতাম। তোতলাতে তোতলাতে স্যার দপ্তরি গেদু ভাইকে বললেন, ‘যা, মহিউদ্দিন খান সাহেবকে ডেকে নিয়ে আয়।’

কলজে পর্যন্ত কেঁপে উঠল। কারণ, খান স্যারের বেতে আস্থা নেই, তিনি স্কুলের ঘণ্টা বাজানোর হাতুড়ি নিয়ে ঘোরেন। তাঁর হাতে অনেক সিনিয়র ভাইয়ের দুরমুজ হওয়ার গুজব বাতাসে ভেসে বেড়ায়। মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করি। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাটালি হিল ঘোরার আজাব যে দুনিয়াতে নেমে আসবে আগে ভাবিনি।

একটু পর হেলতে–দুলতে খান স্যার রুমে ঢুকলেন, হাতে বিখ্যাত হাতুড়ি।

হেড স্যার তখনো কাঁপছেন। বললেন, ‘খান সাহেব, এইটা তো আগে ভালোই ছিল, ফার্স্ট, সেকেন্ড হতো, এখন তো দেখি ছাগল হয়ে যাচ্ছে। এ রকম চললে তো গাধাটা টুল বেঞ্চির মতো স্কুলে পারমানেন্ট হয়ে যাবে। জীবনেও এসএসসি পাস করবে না। আপনি এর দায়িত্ব নেন। ক্লাস নাইনের বছর, এখন থেকে খেয়াল রাখলে গাধাটার কিছু হবে।’

খান স্যার কিছু না বলে রেজাল্ট শিট দেখলেন, প্রথমে তাঁর চোখ কুঁচকে গেল, তারপর সেখানে জ্বলে উঠল দাবানল। হাতুড়িটা তাক করে তিনি কিছুক্ষণ আমাকে দেখলেন, যেন খপ করে গিলে ফেলবেন, তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না। ছাগলটা হয় পড়াশোনা করবে, নয়তো আমি ওকে স্কুলের ঘণ্টা বানিয়ে দিনে দুইবার ঝুলিয়ে পিটাব।’

এরপর শুরু হলো স্যারের নির্দেশিত অমানুষিক রুটিন।

ভোর তিনটায় ঘুম থেকে উঠা, ফজরের নামাজের বিরতি দিয়ে সকাল ৯টা পর্যন্ত পড়া, এরপর স্কুল শেষ করে বিকেল চারটায় চট্টগ্রামের সিজিএস কলোনির ৯ নম্বর মাঠে হাওয়া খাওয়া। সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় পড়তে যাওয়া। সেখানে আরেক ‘বাঘ’ শফিকউল্লাহ স্যার হাজির থাকেন অঙ্ক করানোর জন্য। রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সেখানে বিদ্যা অর্জন। মাঝখানে খেতে হয় বিষের মতো বিরাট এক জামবাটি দুধ। সপ্তাহে তিন দিন হেড স্যারের কাছে ইংরেজি পড়তে যাওয়া। শুক্রবার খাস্তগির স্যারের কাছে পরীক্ষা দেওয়া। (সব কিন্তু বিনা পয়সায়)।

ফরমান জারি হলো আগামী দুই বছর খেলাধুলা আর ‘আউট বই’ বন্ধ।

সবচেয়ে বড় দুর্যোগ নামল ভোরবেলা। মহিউদ্দিন স্যার ফজরের নামাজ শেষ করেই পড়ছি কি না, দেখার জন্য বাসার নিচে এসে হাঁকডাক শুরু করেন, ‘বাদল, নিচে নাম।’

মহা বিরক্ত হয়ে নেমে আসি। তারপর তিনি হালকা ভোরের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে কলোনি মার্কেটে চায়ের দোকানে নিয়ে যান। নিজের এবং আমার জন্য দুটো করে পরোটা আর ডিম পোচের অর্ডার দেন। সঙ্গে গরম চা। এই ব্যাপারটা আমার বেশ পছন্দ হয়। আগ্রহ নিয়ে খাই। এ সময় তাঁকে কিছুটা নরম মনে হয়। চুপচাপ আমার খাওয়া দেখেন আর বলেন, ‘খা বেটা, খা, পড়াশোনা করার জন্য বেশি বেশি খাওয়া দরকার।’
এরপর শুরু হয় আবার কঠিন রুটিন। এর মধ্যে যোগ হন নতুন ‘আজরাইল’ বাংলার কাশেম স্যার। তাঁর বিখ্যাত থাপ্পড়ে আমার দাঁত তো দাঁত, নাক–মুখসহ উড়ে যাওয়ার অবস্থা।

এভাবে দিন যায়। খালি মনে হয় কখন এ কেয়ামত শেষ হবে? মহিউদ্দিন স্যারের কথা মনে হলেই মন বিদ্রোহ করে ওঠে। কিন্তু পালানোর কোনো উপায় নেই। মোটামুটি ২৪ ঘণ্টা তাঁর কড়া নজরদারি। আমি তীব্র অভিযোগ নিয়ে বাবার দিকে তাকাই, তিনি ফাঁদে পড়া বিড়ালছানার দিকে করুণার হাসি হেসে ইত্তেফাকে মনোযোগ দেন।
একসময় এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয় আর আমি সেদিনই সব বই তীব্র রাগে পুরোনো কাগজের দোকানে বিক্রি করে বিখ্যাত সিনেমা হল ‘আলমাসে’ গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখি। ফেরার সময় কিনি আধা ডজন ‘মাসুদ রানা’।

তারপর শুরু হয় স্বাধীনতার নতুন ইতিহাস।

কেবল ‘মাসুদ রানা’ আর তক্তা কেটে বানানো ক্রিকেট ব্যাট আমার নিত্যসঙ্গী। সকাল থেকে সন্ধ্যা। পরীক্ষার কথা, ফলাফলের কথা চিন্তাও করি না। গুল্লি মারি পরীক্ষার ফল।
এ রকম এক বিকেলে গভীর মনোযোগের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছি। দুনিয়া তখন ছুটে আসা বল পিটানোতে ব্যস্ত। হঠাৎ পেছন থেকে খান স্যারের বাজখাঁই গলা শুনে চমকে উঠলাম।
‘ফাজিলের ফাজিল, একটু আগে তোর এসএসসির রেজাল্ট দিয়েছে, স্যাররা স্কুলে অপেক্ষা করছেন আর তুই এখানে জাভেদ মিয়াঁদাদগিরি ফলাচ্ছিস! মাথা গুঁড়া গুঁড়া করে দেব, একদম গুঁড়া গুঁড়া, তুই বোর্ডে ফিফথ হয়েছিস গাধা...’ বলতে বলতে ছোটখাটো মানুষটি বিদ্যুৎবেগে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে স্কুলের দিকে দৌড়াতে লাগলেন।

আমি বুঝতে পারছি না এটা কী হচ্ছে? চোখ মেলে তাকাতেও পারছি না, স্যারের তপ্ত ঘাম কিংবা আনন্দাশ্রু টপটপ করে পড়ে আমার চোখের পাতা বুজে দিচ্ছে....।

লেখক: সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ, কর কমিশনার, চট্টগ্রাম

*প্রথম আলো–আইপিডিস আমাদের শিক্ষকদের সম্মান জানানোর একটা উদ্যোগ নিয়েছে। আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা। আপনার শৈশবের প্রিয় শিক্ষককে মনোনীত করতে লগইন করুন