দিবসভিত্তিক কর্মসূচি নিয়েই ব্যস্ত আ.লীগ

আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগ

টানা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে দল ক্ষমতায়। সরকার যতটা শক্তিশালী, আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে ততটা শক্তিশালী কি না, সেই আলোচনা শুরু হয়েছে দলের ভেতরেই। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে দলের নীতিনির্ধারকেরা যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। আর কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলেও তা নামকাওয়াস্তে। দলীয় কর্মকাণ্ড অনেকাংশেই দিবসভিত্তিক কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

দলের বর্তমান কমিটির মেয়াদ আগামী মাসে শেষ হচ্ছে। আরেকটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তবে পরবর্তী সম্মেলন এক মাস পেছাতে পারে বলে দলের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ পরিস্থিতিতে দলকে সংগঠিত করার তাগিদ অনুভব করছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা।

আগামী শনিবার গণভবনে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক বসছে। ওই বৈঠকে, দলের পরবর্তী জাতীয় সম্মেলন, তৃণমূলের সম্মেলন, সিটি নির্বাচন এবং দলের ভেতর থাকা দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

আওয়ামী লীগের জেলা, মহানগর, উপজেলাসহ তৃণমূলের কমিটিগুলোর বেশির ভাগেরই মেয়াদ শেষ। জাতীয় সম্মেলনের আগে কমিটিগুলো হালনাগাদ করার লক্ষ্যে গত মার্চে কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে আটটি কমিটি করা হয়েছে। তাদের বিভিন্ন জেলায় সফর করে তৃণমূলে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন এবং দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে কাজ করার কথা। তবে এসব কমিটির তেমন কার্যক্রম দেখা যায়নি। ২০১৬ সালে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগকে উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত করে দুটি কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। তিন বছরেও উত্তরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। এর মধ্যে দুই দফা কমিটি ঘোষণা করা হলে প্রবল আপত্তির মুখে তা স্থগিত করা হয়।

গত ১ জুলাই থেকে আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সেই অভিযান এখনো শুরুই হয়নি। সদস্য সংগ্রহ অভিযানে পুরোনোদের সদস্য পদ নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহের কথা ছিল।

গত এপ্রিলে কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া এবং তাঁদের মদদদাতা মন্ত্রী-সাংসদদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর জুলাইয়ে পুনরায় একই সিদ্ধান্ত হয়। তবে ছয় মাসেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। গতকাল সোমবার থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে মদদদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে পিছু হটেছেন নীতিনির্ধারকেরা।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, শোক দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী, দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ কিছু দিবসভিত্তিক কর্মসূচিতে দল সীমাবদ্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে বন্যা ও ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়া সবচেয়ে বড় দুর্যোগ হিসেবে দেখা দেয়। দলের নেতারা এসব দুর্যোগে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা নির্দেশ দেওয়ার পর নামকাওয়াস্তে মাঠে নামেন কেউ কেউ। সচিবালয় ও সরকারি দপ্তরে যত নেতা-কর্মী তদবিরের জন্য ঘোরাঘুরি করেন, তত লোক দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেন না। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন এলে মনোনয়ন পেতে অর্থ-শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অর্থাৎ সরকারের বিভিন্ন পদে বসা, সরকারি সুবিধা নেওয়া এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়া—মূল লড়াই এগুলো নিয়েই।

>

দলের বর্তমান কমিটির মেয়াদ আগামী মাসে শেষ হচ্ছে
আরেকটি সম্মেলন অনুষ্ঠানের সময় ঘনিয়ে এসেছে
পরবর্তী সম্মেলন এক মাস পেছাতে পারে
জেলা কমিটিগুলো হালনাগাদই হয়নি
বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, দলীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও সাংগঠনিক কর্মসূচিতে ভাটার পেছনে মূল কারণ তিনটি। এগুলো হচ্ছে মাঠপর্যায়ে ব্যাপক দ্বন্দ্ব-কোন্দল, শক্ত বিরোধী দলের অভাব এবং রাজনীতি শুধু নির্বাচননির্ভর হয়ে পড়া।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, বন্যা, শোকের মাসের কারণে তৃণমূলের কর্মসূচিতে কিছুটা গতি কমেছে। চলতি মাস থেকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে আবারও গতি এসেছে।

সম্মেলনের আওয়াজ আছে, প্রস্তুতি নেই

আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ২০১৬ সালের অক্টোবরে। সে হিসাবে আগামী মাসেই এর মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ইতিমধ্যে পরবর্তী সম্মেলন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দলে আলোচনা চলছে। দলের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, অক্টোবরে না হলেও নভেম্বরে সম্মেলন হতে পারে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে জাতীয় সম্মেলনের আগে জেলা–উপজেলাসহ তৃণমূলের সব পর্যায়ে সম্মেলন সম্পন্ন করে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। তবে এ কাজে বেশ পিছিয়ে আছে দলটি। সারা দেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক জেলা ৭৮টি।

দলীয় সূত্র জানায়, একমাত্র মৌলভীবাজার জেলা কমিটি হয়েছিল দলের গত জাতীয় সম্মেলনের পরে। বাকি সব কমিটিই জাতীয় সম্মেলনের আগে হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমান কমিটির মেয়াদে ৭৭টি সাংগঠনিক জেলায় নতুন করে সম্মেলন করার কথা। কিন্তু একটি জেলায়ও সম্মেলন হয়নি। এর বাইরে উপজেলা কমিটিগুলো আরও পুরোনো। কয়েকটি সহযোগী সংগঠনের সম্মেলন হয়েছে এক দশক বা তারও আগে।

বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না

আওয়ামী লীগের নেতাদের মত হচ্ছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেশ শক্তিশালী হয়েছে। তৃণমূল থেকে প্রায় ২০০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দলের শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করার অভিযোগ আসে। এর মধ্যে শতাধিক নেতা উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁদের মদদদাতা আছেন আরও প্রায় ৬০ মন্ত্রী-সাংসদ। ফলে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সর্বত্রই এই দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়েছে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না–নেওয়া নিয়ে দ্বিধা রয়েছে দলে। এক পক্ষ বলছে, উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত অংশ নেবে না, এটা জানার পর নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে অনেকেই বিদ্রোহী হয়েছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে নমনীয় মনোভাব থাকায় মন্ত্রী-সাংসদের অনেকেই বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়েছেন। এ অবস্থায় বিদ্রোহীদের শাস্তি দেওয়া হলে দলে কোন্দল আরও বাড়বে।

দলের সম্পাদকমণ্ডলীর তিন-চারটি সভায় বিদ্রোহীদের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। প্রতিবারই পক্ষে-বিপক্ষে মত এসেছে। এ জন্যই বিষয়টি ঝুলে গেছে। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে তৎপর নেতাদের যুক্তি হচ্ছে—নৌকা প্রতীক দলের ঐক্যের জায়গা। যাঁরা এই প্রতীকের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের ছাড় দেওয়া হলে দলে শৃঙ্খলা থাকবে না। ইতিমধ্যে নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে দলীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া অনেক প্রার্থী শুধু বিদ্রোহী হয়েই ক্ষান্ত হননি। দলের মনোনীত প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকদের ওপর হামলা করেছেন। ভাঙচুর ও মারামারির ঘটনা ঘটিয়েছেন। এ অবস্থায় তাঁদের ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না।

এ পরিস্থিতিতে শুধু উপজেলা নির্বাচনে যাঁরা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। ২১ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। তবে যাঁরা ইতিমধ্যে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে গেছেন, তাঁদের দল থেকে বের করে দেওয়া যাবে বলে মনে করেন না দলের নেতারাই। তাই এটাকে আনুষ্ঠানিকতা এবং ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতা হিসেবেই দেখছেন নেতারা। এ ছাড়া মন্ত্রী-সাংসদদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া থেকে সরে আসার ফলে এই প্রক্রিয়া আর কতটা এগোবে, সে ব্যাপারে সন্দিহান তাঁরা।

তিন সিটির নির্বাচন মাথায়

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়া এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা ভাবনায় ফেলেছে দলের নীতিনির্ধারকদের।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, ঢাকা উত্তরে তিন বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। দক্ষিণে মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের দ্বন্দ্ব কয়েকবারই প্রকাশ্য হয়েছে। চট্টগ্রামেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট। এ অবস্থা চলতে থাকলে গুরুত্বপূর্ণ এই তিন সিটির নির্বাচন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, আগামী শনিবারের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বেশ কিছু নতুন দিকনির্দেশনা আসতে পারে। এরপরই সাংগঠনিক তৎপরতা বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগের বিস্তার এবং বন্যার কারণে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা স্থবিরতা আসে। জাতীয় সম্মেলন এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে দল চাঙা হয়ে উঠবে। ছোটখাটো যেসব দ্বন্দ্ব–কোন্দল আছে, সেগুলোও থাকবে না।