গ্রামে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে অ্যালবোপিকটাস

ঢাকার বাইরে এডিস অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশা ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) মশা জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে গ্রামকেও শহরের মতো সমান গুরুত্ব দিতে হবে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর মহাখালীর আইইডিসিআর মিলনায়তনে যশোর, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলার মশা জরিপের প্রাথমিক তথ্য প্রকাশ করেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা। এই তিন জেলাতেই এডিস অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশা পাওয়া গেছে। ডেঙ্গুর প্রাথমিক বাহক এডিস ইজিপটাই। এডিস অ্যালবোপিকটাস দ্বিতীয় পর্যায়ের বাহক। অ্যালবোপিকটাসের সংক্রমণক্ষমতা ইজিপটাইয়ের চেয়ে পাঁচ গুণ কম।

ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়ায় এডিস মশা। এডিসের দুটি প্রজাতি—এডিস ইজিপটাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস। কয়েক বছর ধরে বলা হচ্ছে, এডিস ইজিপটাই ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিল্লি আঞ্চলিক কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ববিদ বি এন নাগপাল গত মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় সাংবাদিকদের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, এডিস ইজিপটাই শহর অঞ্চলে জন্ম নিয়ে রোগ ছড়ায়। এডিস অ্যালবোপিকটাস গ্রাম, বনাঞ্চল ও উপশহর এলাকায় রোগের সংক্রমণ ঘটায়। এ বছর ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে মশা নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নাগপালকে ঢাকায় পাঠিয়েছিল।

গত ২০ আগস্ট আইইডিসিআরের বিজ্ঞানী ও গবেষক দল বরিশালে যায়। তারা রোগতাত্ত্বিক জরিপের পাশাপাশি কীটতাত্ত্বিক জরিপও করে। তারা ১২০টি পরিবারের মধ্যে ৬টি পরিবারের পানির পাত্রে লার্ভা পায়। ৫৬টি স্থাপনার ১৯টির পানির পাত্রেও লার্ভা পাওয়া যায়। ঢাকায় আনা এসব লার্ভা থেকে ৭৫৫টি পূর্ণাঙ্গ মশা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি এডিস প্রজাতির, যেখানে ৭টি এডিস অ্যালবোপিকটাস। বাকি ৭টি এডিসের কোন প্রজাতির, তা এখনো নিশ্চিত জানা যায়নি। বাকিগুলো মশার অ্যানোফ্লিক্স, কেউলেক্সসহ নানা প্রজাতির।

কুষ্টিয়ার দাঁড়পাড়ায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ নিয়ে ২৮ আগস্ট প্রথম আলোতে ‘ছোট্ট গ্রামে ডেঙ্গুর বড় আক্রমণ’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এরপর আইইডিসিআরের প্রতিনিধিদল কুষ্টিয়া যায় ৩০ আগস্ট। আইইডিসিআর কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের দাঁড়পাড়ায় ৭১টি পরিবারে রোগতাত্ত্বিক ও কীটতাত্ত্বিক জরিপ করেছে। দাঁড়পাড়ায় সংগৃহীত লার্ভা থেকে ২১টি পূর্ণাঙ্গ মশা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি এডিস অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির। বাকিগুলো অন্য প্রজাতির।

এ বছর ঢাকার বাইরে ৩৪ হাজার ৪১৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। ৭ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত কুষ্টিয়া জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮২৯। এর মধ্যে কুষ্টিয়ার দাঁড়পাড়া এলাকায় এ পর্যন্ত ৫৪ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। আইইডিসিআরের প্রতিনিধিদল দাঁড়পাড়া এলাকা ঘুরে যাওয়ার পর সেখানে আরও ১০ জন আক্রান্ত হয়। গতকাল শুধু কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালেই ভর্তি ছিল ৬৬ জন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন রওশন আরা বেগম হতাশা প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিপদের মধ্যে আছি, প্রতিরোধে আর কী করব, কোনো নির্দেশনাও পাচ্ছি না।’

৫ সেপ্টেম্বর আইইডিসিআরের পরিচালকসহ গবেষক ও বিজ্ঞানীদের দল মেহেরপুরের গাংনী গিয়েছিল। গাংনীর লার্ভা থেকে হওয়া ২৩৭টি মশার মধ্যে ১১৬টি এডিসের বিভিন্ন প্রজাতির। এর মধ্যে ৭৮টি এডিস অ্যালবোপিকটাস, ৪টি এডিস ইজিপটাই। বাকিগুলো সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি আইইডিসিআর।

গতকালের অনুষ্ঠান শেষে আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার বাইরে স্থানীয়ভাবে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে, এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। আবার গ্রামে এডিস অ্যালবোপিকটাসও পাওয়া যাচ্ছে। এর থেকে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে এডিস অ্যালবোপিকটাস ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, এডিস ইজিপটাই সাধারণত শহরে ও ঘরের ভেতরে থাকে। আর এডিস অ্যালবোপিকটাস থাকে গ্রামে। দুই ধরনের মশা নিধন ও নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি হতে হবে আলাদা।

কুষ্টিয়ার ছোট একটি জায়গায় এত মানুষ কীভাবে সংক্রমিত হলো, তা আরও খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এডিস অ্যালবোপিকটাসকে গৌণ সংক্রামক ভাবা হয়, তারা কি তাহলে ততটা গৌণ নয়? এসব বিষয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও বিশ্লেষণ দরকার। তাঁর মতে, শুধু শহর বা শুধু গ্রামকেন্দ্রিক মশা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা থেকে সরে আসার সময় এসেছে। অ্যালবোপিকটাস ও ইজিপটাই নিয়ন্ত্রণে জাতীয়ভাবে পরিকল্পনা করা দরকার।