ফাঁকা চেক দিয়ে পণ্য লুটে নেন তিনি

মো. মশিউর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
মো. মশিউর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

তিন মাসের জন্য আলিশান অফিস ভাড়া নেন তিনি। চলাচল করেন দামি গাড়িতে। পাঁচ তারকা হোটেল ছাড়া ব্যবসায়িক কোনো সভাতেই বসেন না। নানাজনের সঙ্গে লাখ লাখ টাকার পণ্য কেনার ব্যবসায়িক চুক্তি করেন। আস্থায় নিতে অগ্রিম কিছু টাকাও দিয়ে দেন। ব্যবসায়ী যখন অগাধ বিশ্বাসে সব পণ্য সরবরাহ করেন তখনই শুরু হয় টালবাহানা। টাকা আজ দিচ্ছেন তো কাল, এমন করে ব্যবসায়ীদের ঘোরাতে থাকেন। আর মাস তিনেক পেরোতে না পেরোতেই তিনি লাখ লাখ টাকার পণ্য নিয়ে লাপাত্তা। আর তখন ব্যবসায়ীর হাতে পড়ে থাকে কেবল কিছু ফাঁকা (ডিজঅনার) চেক।

গত ২৫ বছরে এমন অনেক প্রতারণা করে ওই ব্যক্তি বহু ব্যবসায়ীর কাছে ফাঁকা চেক দিয়ে নিজে হাতিয়ে নিয়েছেন অন্তত ২৫ কোটি টাকা।

একের পর এক এমন প্রতারণা করা এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা পূর্ব বিভাগ। তাঁর নাম মো. মশিউর রহমান। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায়। থাকেন রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায়। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারণা ছাড়াও জাল টাকা ও ডলারের সঙ্গেও এই ব্যক্তি জড়িত। বুধবার সবুজবাগ এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাঁর কাছ থেকে ৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকার জাল নোট এবং ৬ হাজার মার্কিন ডলার জব্দ করা হয়। ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় তাঁর নামে ১২টি প্রতারণা এবং দশের অধিক চেক জালিয়াতি মামলা রয়েছে। ভুক্তভোগী লোকজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে এই ব্যক্তি অন্তত ২৫ কোটি টাকার পণ্য প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছেন।

মশিউর রহমানকে দুদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসা করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তাঁকে গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে আজ বৃহস্পতিবার মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে আসেন অনেক প্রতারিত ও ভুক্তভোগী ব্যক্তি। তাঁদের কেউ ব্যবসায়িক চুক্তি অনুযায়ী মশিউরকে লাখ লাখ টাকার ইলেকট্রনিক্স পণ্য সরবরাহ করেছিলেন। কেউ চাল, কেউ আলু কেউবা হার্ডওয়ার সামগ্রী সরবরাহ করেছিলেন।

আজম হোসাইন নামের এক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের জুন মাসে মশিউরের সঙ্গে একটি ব্যবসায়িক চুক্তি হয়েছিল তাঁদের। তখন তাঁর অফিস ছিল বনানী ৪ নম্বর সড়কে। চুক্তি অনুযায়ী ৪২টি শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) তাঁকে সরবরাহ করেন। এরপর তাঁরা যখন টাকা চাইতে যান, তখন আজ-কাল করে তাঁদের ঘোরাতে থাকেন। কয়েকটি চেক দেন। কিন্তু ব্যাংক থেকে যখন টাকা তুলতে যান তখন দেখেন অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই।

বেঙ্গল গ্রুপের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) দেবাশীষ বড়ুয়া বলেন, বেঙ্গলের লিনেক্স ইলেকট্রনিকস থেকে গত বছর ৫৩ লাখ টাকার জিনিসপত্র কিনেছিলেন মশিউর রহমান। এক মাস পেরিয়ে গেলেও তিনি যখন টাকা দিচ্ছিলেন না, তখন তাঁর গোডাউন থেকে তাঁরা পণ্যগুলো ফেরত নিয়ে আসেন। কিন্তু তত দিনে ৬ লাখ ২৩ হাজার ৭ টাকার পণ্য মশিউর বিক্রি করে দেন। সেই টাকাটা তাঁরা আর পাননি।

মো. বিলাল হোসেন নামের আরেক ভুক্তভোগী বলেন, তাঁদের কাছ থেকে ২৫টি এসি কিনেছিলেন মশিউর। চুক্তির পরপরই ২০ শতাংশ টাকা অগ্রিম দিয়ে দেন। তাঁরা যখন সব এসি সরবরাহ করেন, তখন মশিউর ১১ লাখ ৯৬ হাজার টাকার একটি চেক দেন তাঁদের। কিন্তু চেকটির বিপরীতে কোনো ব্যাংকে গিয়ে তাঁরা কোনো টাকা পাননি। ফিরে এসে দেখেন মশিউর নেই, তাঁর কার্যালয়ও বন্ধ।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, মাস তিনেক আগে সেনাবাহিনীর দুজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাঁদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেন। তাঁদের একজনের কাছে থেকে মশিউর ৬৫ লাখ টাকার চাল নিয়েছিলেন। আর অন্যজনের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন ৫০ লাখ টাকা। মশিউরের দেওয়া চেক দিয়ে তাঁরা যখন ব্যাংক থেকে টাকা নিতে যান, তখন দেখেন ব্যাংকে টাকা নেই।

খিলগাঁও অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত তিন মাস ধরে মশিউরের সন্ধান করছিলেন তাঁরা। বুধবার জাল টাকার একটি লেনদেন করার সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হন। তিনি বলেন, ২০-২৫ বছর ধরে মশিউর এই কাজ করে আসছেন। এখন পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরা, বনানী, নিকুঞ্জ, শান্তিনগর ও পল্টনে বিভিন্ন সময়ে তাঁর কার্যালয় ছিল বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। ভুক্তভোগী লোকজনের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগ, অন্তত ২৫ কোটি টাকার পণ্য মশিউর বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে প্রতারণা করে নিয়েছেন। তবে টাকার অঙ্ক আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। শাহিদুর রহমান বলেন, পাঁচ থেকে সাতজনের একটি সংঘবদ্ধ চক্র এই কাজটি করে থাকে। অন্যদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।