চন্দন বাউশ এবং একটি দুর্লভ প্রজাতির মাছের কথা

চন্দন বাউশ বা দুধিয়া বাউশ। অপূর্ব স্বাদের এই মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। ছবি: লেখক
চন্দন বাউশ বা দুধিয়া বাউশ। অপূর্ব স্বাদের এই মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। ছবি: লেখক

প্রায় দেড় হাজার নদ-নদী মাকড়সার জালের মতো আমাদের দেশ ঘিরে রেখেছে। এই নদ-নদীগুলো আবহমানকাল ধরে অকৃপণভাবে তীরবর্তী প্লাবনভূমিতে পলি ঢেলে দিয়ে সোনালি ধানে আমাদের ধনী করেছে। পাশাপাশি স্বাদুপানির অসংখ্য বিচিত্র প্রজাতির মাছ দিয়েও আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। সেই সুদূর অতীতকাল থেকে স্বাদুপানির মাছের প্রাচুর্য ও প্রজাতিবৈচিত্র্যে বাংলাদেশ বিশ্বে এক অনন্য উদাহরণ।

বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর থেকে ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাদুপানির মাছ’ নামের বইটিতে স্বাদুপানির মোট ২০৯টি প্রজাতির মাছের বিবরণ রয়েছে। জানা গেছে, এ দেশের নদ-নদীতে বিচরণ করছে ২৭০ প্রজাতির মাছ। আরও অনেক প্রজাতির মাছ রয়েছে, যেগুলোর উল্লেখ করা হয়নি বইটিতে। চন্দন বাউশ সম্পর্কে বলার আগে কয়েকটি বিরল প্রজাতির মাছ বিষয়ে কিছু তথ্য দিয়ে রাখি।

বাংলাদেশের উত্তরে কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার পূর্ব দিক দিয়ে বয়ে গেছে গঙ্গাধর ও শিয়ালদহ নামের দুটি অভিন্ন নদী। এই দুটি নদীতে বিরল প্রজাতির দুটি মাছ রয়েছে—এর একটির নাম ঘোড়েয়া, অপরটি পুঁটিতর। ঘোড়েয়ার সর্বোচ্চ ওজন ১৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। পুঁটিতর পুঁটি মাছের মতো দেখতে এবং এর ওজন সাধারণত পাঁচ কেজি কিংবা তার বেশি হয়ে থাকে। এই অঞ্চলের কয়েকজন মৎস্যজীবী জানিয়েছেন, পুঁটিতর ও সোমেশ্বরী নদীর মহাশোল একই মাছ।

করতোয়া নদীর উৎস বাংলাদেশ অংশে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়ন এলাকা। এই নদীতে রয়েছে অপূর্ব স্বাদের বিরল প্রজাতির মাছ উটটা ও রাইচ্যাঙ। উটটা মাছ উটের পিঠের আকৃতির এবং সাধারণত ৮ ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে। রাইচ্যাঙ সাদা রঙের মাছ। এটি সর্বোচ্চ এক ফুট দীর্ঘ হয়ে থাকে। আষাঢ় মাসের বানে উজানের জলপাইগুড়ি এলাকা থেকে আসে রাইচ্যাঙ। উটটা ভাটির দিক থেকে উজানের দিকে যায়। এ ছাড়া করতোয়া নদীতে দুধিয়া বাউশ নামে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছ দেখা যায়। পঞ্চগড় জেলা দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদীতে একাধিক দহ রয়েছে, যেগুলো স্থানীয় ভাষায় ‘মণি’ নামে পরিচিত। এই মণিগুলোতে এই মাছ মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে।

আমাদের আলোচ্য চন্দন বাউশ নামের প্রায় বিলুপ্ত মাছের প্রজাতিটি বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, কোচবিহার (ভারত), জলপাইগুড়ি (ভারত) অঞ্চলে দুধিয়া বাউশ নামে পরিচিত। বৃহত্তর বগুড়া, পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলে এই মাছ চন্দন বাউশ নামে পরিচিত।

১৯৯৬ সালে আমার পাবনার বন্ধুদের মাধ্যমে প্রথম জানতে পারি চন্দন বাউশ মাছ সম্পর্কে। মাছটি পাওয়া যেত পদ্মা নদীতে। কিন্তু বন্ধুদের কথায় জানতে পারি, ১৯৯৬ সালের দিকে মাছটি পদ্মা নদীতে প্রায় বিরল হয়ে গেছে।

ইতিমধ্যে অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। ২০০৯ সালে বগুড়ার পোড়াদহের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলায় হাজির হলাম চন্দন বাউশের সন্ধানে। এ মেলায় এক মণ ওজনের বাগাড় থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র পুঁটি মাছও আছে। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে কয়েক শ মাছের দোকান। কিন্তু মাছটি পেলাম না। মাছ না পেলেও মেলায় পাওয়া গেল তথ্য। পাবনার বেড়া উপজেলার কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ী এসেছিলেন মেলায়। তাঁদের একজন লুৎফর রহমান। মাছের আড়ত রয়েছে বেড়া বাজারে। তিনি জানালেন, চন্দন বাউশ যমুনায় মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে এবং আড়তে বিক্রির জন্য আসে। আরও জানা গেল, সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর মাছের বাজারেও চন্দন বাউশ পাওয়া যায়।

পরবর্তী দু–তিন মাসের মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত মাছটি হাতে পেলাম। বেড়া থেকে আসা মাছটির ওজন ছিল দেড় কেজি। শাহজাদপুর থেকে আসা মাছের ওজন এক কেজি। সব মাছই সাদা রঙের। মনে সন্দেহ জাগল আসলেই এগুলো চন্দন বাউশ কি না। কারণ, চন্দন বলতে তখন অবধি মাথায় রক্তচন্দন কাজ করছে—শ্বেতচন্দন নয়। ২০১৪ সালের একপর্যায়ে কৌতূহলবশত রংপুর মাছের বাজারে গিয়েছিলাম। সেখানকার মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে চন্দন বাউশ সম্পর্কে জানা গেল কিছু তথ্য। তাঁরা চন্দন বাউশকে বলেন দুধিয়া বাউশ। রংপুরের মাছের বাজারে খুব কম পাওয়া যায়। চন্দন বাউশের রং কেমন, এই আলোচনায় সেটি আরও বেশি পরিষ্কার হলো।

ইতিমধ্যে কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, দিনাজপুর ও রংপুরের বিভিন্ন স্থানে নদ-নদী নিয়ে সরেজমিন কাজ করতে এসে বিরল প্রজাতির মাছটির সন্ধান আরও ভালোভাবে পাওয়া গেল। করতোয়া নদীর বাংলাদেশে উৎস পঞ্চগড়। সেখান থেকে দিনাজপুরের খানসামা পর্যন্ত করতোয়ার প্রবাহপথে প্রায় ৩০টি উল্লেখযোগ্য দহ রয়েছে। এই দহগুলো থেকে মাছ ধরা হয়। এ সময় দুর্লভ প্রজাতির চন্দন বাউশ (দুধিয়া বাউশ) খুব স্বল্প পরিমাণে হলেও দহগুলোতে ধরা পড়ে।

পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী শহরের স্বাদুপানির মাছের বাজার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই বাজারগুলোতে কালেভদ্রে বিরল প্রজাতির চন্দন বাউশের দেখা মেলে। চন্দন বাউশ রক্তচন্দনের মতো লাল রঙের নয়—এ কথা আগেই বলেছি। এই ভুল ভেঙেছে রংপুরের বাজারে গিয়ে দুধিয়া বাউশ নাম শুনে। চন্দন বাউশের রং সাদা অর্থাৎ শ্বেতচন্দনের মতো। এ কারণেই বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও পাশের এলাকা ভারতের কোচবিহার ও জলপাইগুড়িতে মাছটির নাম দুধিয়া বাউশ।

অপূর্ব স্বাদের দুষ্প্রাপ্য চন্দন বাউশ আজ বিলুপ্তির পথে। ইতিমধ্যেই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার স্বাদুপানিতে বিচরণকারী কয়েকটি প্রজাতির মাছ চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে। বিরল প্রজাতির এই মাছের বিচরণক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। একে বাঁচিয়ে রাখার এখনই উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশ এখন মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই অর্জনে সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অসামান্য। চন্দন বাউশকে বাঁচিয়ে রাখা এবং এর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকারি–বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।