ছাত্রলীগ নেতাদের টাকা 'ভাগের' অভিযোগ সুরাহায় সময় নিলেন উপাচার্য

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নকাজের জন্য তৈরি করা মহাপরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আশ্বাস দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ঘিরে ছাত্রদের তিনটি হল নির্মাণের যে স্থান ঠিক করা হয়েছিল, সেটি পুনর্নির্ধারণ করা হবে। এর মধ্যে একটি হল নির্ধারিত স্থানের ১০০ ফুট দূরে সরিয়ে নেওয়া হবে। আর দুটি হলের নতুন স্থান আলোচনার ভিত্তিতে শিগগির ঠিক করা হবে। বৈঠকে উন্নয়নকাজের জন্য ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারার অভিযোগ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। এ বিষয়ে আইনি পরামর্শের জন্য আগামী বুধবার পর্যন্ত সময় নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ বিষয়ে বুধবার আবার সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার উপাচার্য ফারজানা ইসলামসহ প্রশাসনের পাঁচজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠক শেষে রাত পৌনে ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিল কক্ষে সাংবাদিকদের কাছে সভার সিদ্ধান্ত জানান ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ।

ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার বলেন, পর্যালোচনার ভিত্তিতে মহাপরিকল্পনার প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে এবং মহাপরিকল্পনা পর্যালোচনায় যে বিশেষজ্ঞ কমিটি রয়েছে, তা–ও পুনর্গঠন করা হবে। প্রকল্পের কাজের গুণগত মান নিরীক্ষার জন্য বিশেষায়িত কমিটি গঠন করা হবে। এ ছাড়া প্রকল্প ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ওই বৈঠকে উন্নয়নকাজের জন্য ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে টাকা ভাগ–বাঁটোয়ারার অভিযোগ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। এ বিষয়ে আইনি পরামর্শের জন্য আগামী বুধবার পর্যন্ত সময় নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ বিষয়ে বুধবার আবার সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বৈঠকে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারী শিক্ষকদের একজন রায়হান রাইন প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্র-শিক্ষকদের তিন দফা দাবির মধ্যে উপাচার্য দুই দফা দাবি মেনে নিতে সম্মত হয়েছেন। বাকি এক দফা অর্থাৎ অর্থ লেনদেনের অভিযোগের বিষয়ে সময় নিয়েছেন। অধ্যাপক রায়হান আরও বলেন, বুধবারের আলোচনায় যদি বিষয়টির সুরাহা না হয়, তাহলে আবারও আন্দোলনে নামতে পারেন। এর আগ পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিত থাকবে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানা যায়, ক্যাম্পাসজুড়ে প্রায় ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪১ ধরনের কাজ ও কেনাকাটা হবে। এর মধ্যে ২৩টির মতো ভবন নির্মিত হবে। কিন্তু বিপুল এই উন্নয়নকাজ নিয়ে বড় ধরনের বিতর্কের মুখে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মূলত দুটি কারণে এই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, ‘পূর্ণাঙ্গ মহাপরিকল্পনা’ ছাড়াই এসব উন্নয়নকাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের ক্ষতি করা হচ্ছে বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অভিযোগ করে আসছে। দ্বিতীয়ত, নির্মাণকাজে যাতে বাধা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য উপাচার্যের মধ্যস্থতায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ নেতাদের বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দেওয়াসংক্রান্ত আরেকটি অভিযোগ ক্যাম্পাসের ছাত্র-শিক্ষকদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।

এ দুটি অভিযোগ ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। আন্দোলনকারীদের একটি পক্ষ বলছে, তাঁরা উন্নয়নের বিরোধী নন। কিন্তু তাঁরা চান প্রাণ–প্রকৃতিতে ভরপুর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে পূর্ণাঙ্গ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী কাজটি হতে হবে। আর ‘আর্থিক দুর্নীতির’ যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি আচার্য তথা রাষ্ট্রপতির নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তদন্ত করে সুরাহা করতে পারে। অন্যদিকে সরকার-সমর্থক ও উপাচার্যপন্থী শিক্ষকেরা বলছেন, ‘মিথ্যা অভিযোগ’ তুলে উন্নয়নকাজে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে।

তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান কাজী শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত ইউজিসি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে যেহেতু বিষয়টি দীর্ঘ হচ্ছে, তাই বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠু রাখার জন্য এখানে ইউজিসি কী ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

প্রশ্নবিদ্ধ মহাপরিকল্পনা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে ৩৫০ কোটির বেশি টাকা ব্যয়ে আগের মতো চার-পাঁচতলার কয়েকটি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা হয়। পরে সরকার ১০ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত ভবন করার পক্ষে মত দেয়। গত জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে সাড়ে ১৪ শ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প একনেকের সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আওতায় ২০২২ সালের মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তাদের জন্য অনেকগুলো বহুতল ভবন হওয়ার কথা।

গত ৩০ মে শিক্ষার্থীদের পাঁচটি আবাসিক হলের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়। প্রথমে ই-টেন্ডার না হওয়ার অভিযোগ ওঠে। এরপর সনাতন পদ্ধতিতে দরপত্র গ্রহণ শুরু হওয়ার সময় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ করে জানায়, ছাত্রলীগের ২০-৩০ জন নেতা-কর্মী তাঁদের কেনা দরপত্র ছিনিয়ে নিয়েছেন।

এর মধ্যেই ঢাকা–আরিচা মহাসড়ক লাগোয়া ক্যাম্পাস এলাকায় ছাত্রীদের দুটি হল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। গত ২২ জুলাই ছাত্রীদের দুটি হল নির্মাণের স্থানে গাছ কাটা শুরু হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ বাধা দেয়। এরপর ৩ আগস্ট একই স্থানে আবার গাছ কাটা শুরু হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তখনো বাধা দেন। এর মধ্যেই শুরু হয় ঈদের ছুটি। ছুটি শেষে দেখা যায়, ওই স্থানের গাছ কেটে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

গত ২৩ আগস্ট সকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ঘিরে ছেলেদের তিনটি হল নির্মাণের স্থানে গাছ কাটা শুরু করেন শ্রমিকেরা। তখন সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বাধা দিলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ওই দিনই উন্নয়নকাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য ছাত্রলীগকে বড় অঙ্কের টাকা দেওয়ার অভিযোগ প্রকাশ পায়। তখন থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ টানা আন্দোলন করে আসছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় প্রথম মহাপরিকল্পনা করেন প্রখ্যাত স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। কিন্তু এবার সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা না করেই অসম্পূর্ণ একটি মহাপরিকল্পনা করে নির্মাণকাজ শুরু করায় আপত্তি ওঠে। পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, প্রাণ–প্রকৃতিনির্ভর প্রায় ৭০০ একর ভূমির ওপর বিশ্ববিদ্যালয়টি। এখানে উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন হওয়ায় আনন্দিত। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ মহাপরিকল্পনা ছাড়াই কাজটি হলে ক্যাম্পাসের ক্ষতি হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম আবুল কালামও মনে করেন, যে মহাপরিকল্পনার ভিত্তিতে উন্নয়নকাজটি শুরু হয়েছে, তাতে পুরো ক্যাম্পাস নিয়ে বিশদ পরিকল্পনা নেই। আর এই মহাপরিকল্পনাকে খণ্ডিত বলেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান।

এদিকে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব ঠিক রেখে সমন্বয় করলে তাতে একমত থাকার কথা জানান উপাচার্যপন্থী বলে পরিচিত শিক্ষকদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক বশির আহমেদ।

উন্নয়নকাজের পরিবেশগত ছাড়পত্র না থাকা নিয়েও বড় প্রশ্ন উঠেছে। যদিও প্রকল্পের পরিচালক নাসির উদ্দিন বলছেন, সম্ভাব্যতা পরীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) করা হয়েছে। এখানে পরিবেশগত ছাড়পত্রের প্রয়োজন নেই।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো একটি এলাকায় ১০ তলা ভবন করতে হলে শুধু সম্ভাব্যতা যাচাই করেই নির্মাণকাজ শুরু করা যাবে না। ওই ভবন নির্মাণের ফলে সেখানে কী ধরনের পরিবেশগত প্রভাব পড়বে, তার সমীক্ষা করতে হবে, যাকে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) বলা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকায় এতগুলো বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই সব কটি স্থাপনার সম্ভাব্য পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করতে হবে।

আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ
হলের স্থান নির্ধারণ ও মহাপরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই ঈদুল আজহার আগমুহূর্তে গত ৯ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলামের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগের একাধিক উপদলের নেতারা ‘বৈঠক’ করেন। সেখানে উন্নয়নকাজ ঘিরে ছাত্রলীগ নেতাদের বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে কথা হয়। সাংবাদিকের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাদের কথোপকথনে একটি অডিও রেকর্ডে এক কোটি টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারার কথা উঠে আসে। যদিও ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকদের মুখে দুই কোটি টাকার কথা আলোচিত হচ্ছে। উপাচার্যের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাদের ‘বৈঠকে’ উপাচার্যের স্বামী ও ছেলে থাকা নিয়েও নানা রকম আলোচনা আছে।

অবশ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা আর্থিক লেনদেনের অভিযোগকে ভিত্তিহীন উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যা ছিল, উপাচার্য মিটমাট করে চলতে বলেছেন। আর এটা কোনো বৈঠক ছিল না, সাক্ষাৎ বলতে পারেন।’ অডিও বিষয়ে তিনি বলেন, হতাশ হয়ে সংগঠনের কেউ এ ধরনের কথা বলে থাকতে পারে।

উপাচার্যের সঙ্গে ওই বৈঠকে তাঁর স্বামী ও ছেলে থাকার বিষয়ে ছাত্রলীগ নেতা জুয়েল রানা বলেন, বাসায় ঢোকার সময় উপাচার্যের স্বামী ও ছেলের সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়েছে।

উপাচার্যের বক্তব্য
এসব বিষয় নিয়ে উপাচার্যের দপ্তরে কথা হয় প্রথম আলোর। ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন। ঈদের আগে ছাত্ররা সব সময় তাঁর কাছে যায় উল্লেখ করে উপাচার্য ফারজানা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাদের নিজেদের মধ্যে একটি ‘গন্ডগোল’ আছে, তাদের সতর্ক করে দিয়েছি, সামনে বড় কাজ আছে, বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে যাচ্ছে, কোনোভাবেই নিজেদের মধ্যে দূরত্ব রাখতে পারবে না।’

তবে টাকা লেনদেনের অভিযোগকে মিথ্যা উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, পরামর্শক ফি ও প্রকল্পের গাড়ির টাকা ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পের আর কোনো টাকা ছাড় হয়নি। যে টাকা ছাড় হয়নি, তা নিয়ে বিলিবণ্টন করার অভিযোগকে মিথ্যা বলে উল্লেখ করেন তিনি।

মহাপরিকল্পনা নিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্য ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘আমরা বলব এটা মহাপরিকল্পনা। পূর্ণাঙ্গ বা অপূর্ণাঙ্গ আমরা বলব না। তবে এতে সংযোজন-বিয়োজন হতেই পারে।’