কাদেরপন্থীদের 'কৌশলগত' পিটটানে জয় দেখছেন রওশনপন্থীরা

রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের। প্রথম আলো ফাইল ছবি।
রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের। প্রথম আলো ফাইল ছবি।

জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর দলটির নেতৃত্বে কে আসবেন, তা নিয়ে জটিলতার আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। স্ত্রী রওশন এরশাদ, নাকি ভাই জি এম কাদের দলের হাত ধরবেন, তা নিয়ে আলোচনা যেমন ছিল, তেমনি দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাও এই দুজনকে ঘিরে দুটি বলয় আগেই তৈরি করে রেখেছিলেন। তবে এরশাদ মারা যাওয়ার আগে ভাই জি এম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার পর মনে হচ্ছিল পরিস্থিতি যেন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছে। দলটি হয়তো বড় ধরনের সংকটে পড়তে যাচ্ছে না।

কিন্তু এরশাদের মৃত্যুর মাত্র দুই মাসের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে দেবর-ভাবির বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নেয়। দলের নেতারা বলছেন, জি এম কাদের দলে ‘একক আধিপত্য’ বিস্তারের চেষ্টা চালানোয় রওশন এরশাদ ও তাঁর সমর্থকদের এটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। এ কারণে দলে ‘ভাঙন’ নিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত জি এম কাদের ও তাঁর পক্ষের নেতারা কিছুটা পিছু সরে আসায় জাতীয় পার্টি বড় ধরনের ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। জি এম কাদেরের অনুসারী নেতা–কর্মীরা একে ‘কৌশলগত পিটটান’ বলে প্রথম আলোর কাছে মন্তব্য করেছেন।

জাতীয় পার্টিতে যাঁরা কাদের বা রওশন কারও পক্ষেই নন, তারা মনে করেন, দলে যে দুটি বলয় তৈরি হয়েছে তা থেকে দলকে ঐক্যবদ্ধ করা কঠিন। আপাতত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেলেও দলের কাউন্সিল নিয়ে পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হতে পারে। ওই নেতারা বলছেন, যাঁরা কাদের বা রওশনকে ‘বুঝিয়ে’ দলে বিভেদ তৈরির চেষ্টা করছেন, তাঁরা মূলত দলের ক্ষতি করছেন। নিজেদের লাভের জন্য তা করছেন।

জাপার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলছেন, এরশাদের মৃত্যুর পর জি এম কাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান থেকে দলের চেয়ারম্যান হয়েছেন। এটা সবাই মনে নিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি কাদের সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তা ছাড়া রংপুর-৩ আসনে এরশাদের ছেলে সাদ এরশাদকে মনোনয়ন দেওয়ার বিরোধী ছিলেন তিনি। ফলে দলে জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে যাঁদের অবস্থান, তাঁরা রওশন এরশাদকে ‘বুঝিয়ে’ বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। তাঁরা রওশনকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করে আলাদা বলয় তৈরি করতে পেরেছিলেন।

জাপা নেতারাই বলছেন, জি এম কাদের নিজেকে বিরোধীদলীয় নেতা করা ও সাদকে মেনে না নেওয়ার অবস্থান থেকে সরে না এলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। জাপায় ভাঙন প্রকাশ্য হতো। বিভেদও বাড়ত, যা দলটিকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেত।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা প্রথম আলোকে বলেন, একটি খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সামাল দেওয়া গেছে। তিনি বলেন, ‘আপাতত আমরা এটা ভুলে যেতে চাই। সামনে রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচন। আসনটি জাপার হাতে থাকুক সেটা সবাই চায়। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সবাই যাঁর যাঁর জায়গা থেকে কাজ করবেন, এটাই প্রত্যাশা।’ দলীয় মহাসচিব বলেন, দলের মধ্যে এখন আর কোনো সমস্যা নেই। এখন সবাই ঐক্যবদ্ধ।

সূত্র জানায়, গত শনিবার রাতে ঢাকার বারিধারার কসমোপলিটন ক্লাবে বৈঠকে বসেন রওশন ও কাদেরপন্থীরা। সেখানে রওশন এরশাদের সমর্থকদের মধ্যে ছিলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ফখরুল ইমাম, মুজিবুল হক চুন্নু, সেলিম ওসমান ও এস এম ফয়সাল চিশতী। জি এম কাদেরের পক্ষের নেতাদের মধ্যে ছিলেন কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা।

জাতীয় পার্টির পরবর্তী কাউন্সিল ২১ ডিসেম্বর করার ঘোষণা জি এম কাদেরই দিয়েছেন। সেই পর্যন্ত দলের চেয়ারম্যান তিনিই থাকছেন এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর রওশন এরশাদ সংসদে দ্বিতীয় মেয়াদে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করবেন। সঙ্গে উপনেতা হিসেবে নিজেই জি এম কাদেরকে বেছে নিয়েছেন। ফলে জাতীয় পার্টিতে একটা সমঝোতা হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, দলে এইচ এম এরশাদের একক ক্ষমতা সবাই মনে নিয়েছিল। কিন্তু জি এম কাদেরের ক্ষেত্রে সেটা হবে না। এ জন্য গঠনতন্ত্র পরিবর্তনের কথাও ভাবা হচ্ছে।
গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতায় পরিবর্তনের কথা দলটি ভাবছে বলে জানিয়েছেন মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাও।

দলের নেতারাই বলছেন, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে সাম্প্রতিক দুটি পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের পর কে জয়ী আর কার পরাজয়, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কেউ উচ্ছ্বসিত, কেউ বা নিজেদের পরাজিত ভাবছেন। এই নেতারা বলছেন, এ অবস্থায় জাতীয় পার্টি কত দিন ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারবে, তা নিয়ে সবার মধ্যেই সন্দেহ আছে।

অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, রওশন এরশাদ নিজে বিরোধীদলীয় নেতা হয়ে উপনেতা হিসেবে জি এম কাদেরকে বেছে নেওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ভবিষ্যতে জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দলীয় কার্যক্রম এবং রওশন সংসদে দলের কর্মকাণ্ডের প্রধান হয়ে ‘বাধাহীন’ দায়িত্ব পালন করতে পারলে জাতীয় পার্টি হয়তো এক থাকতে পারবে।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, কিছুটা ভুল–বোঝাবুঝি বা সমস্যা হয়েছিল। এটা কেটে গেছে। সবাই মিলে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়েছে। তিনি বলেন, এখানে কেউ জিতেছে বা কেউ হেরেছে, তা বলা যাবে না। জাতীয় পার্টির সব নেতা–কর্মী জয়ী হয়েছেন। এখন ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই জরুরি। জাতীয় পার্টি সেই পথেই হাঁটবে।