ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়াল

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ মূলত ঢাকা শহরে হলেও এবার তা গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মোট রোগীর ৪৪ শতাংশই ঢাকার বাইরে। আগস্ট মাসের তুলনায় এ মাসে নতুন রোগীর সংখ্যা কমে এলেও ঢাকার বাইরের কয়েকটি জেলার গ্রামাঞ্চলে তা বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, গ্রামে মশা নিয়ন্ত্রণ কিংবা নিধন করা কঠিন।

এ বছর গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮০ হাজার ৪০ জন রোগী সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ঢাকা শহরের বাইরে ছিল ৩৫ হাজার ৩৭৩ জন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে এত বেশিসংখ্যক রোগী এর আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। ইতিমধ্যে চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ছেড়েছে ৭৬ হাজার ৯৩৭ জন।

বাংলাদেশে ব্যাপক হারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয় ২০০০ সালে। কিন্তু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল গত বছর, মোট ১০ হাজার ১৪৮ জন। আর এ বছরের শুধু আগস্ট মাসেই ভর্তি হয়েছিল ৫২ হাজার ৬৩৬ জন।

গত কয়েক বছরের তথ্যে দেখা গেছে, এপ্রিলে শুরু হয়ে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। সেপ্টেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। এ বছর পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টেছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। আগস্টের পর সংক্রমণ বেশ কিছুটা কমেছে। তারপরও এখনো যা দেখা যাচ্ছে, তা বিগত বছরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দিনে ১০০ জনের মতো রোগী ভর্তি হতো। এ বছরের সেপ্টেম্বরে তা ৬৫০ জনের বেশি। গতকাল ভর্তি হওয়া ৬৭২ জন রোগীর মধ্যে ৪৪৪ জন ছিল ঢাকার বাইরে।

গতকাল যশোরের সিভিল সার্জন দিলীপ রায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। ‘আমরা খুব বিপদে আছি’ এই কথা দিয়েই তিনি আলাপ শুরু করেন। গতকাল এই জেলায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৯০ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিল। এই সংখ্যা রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নতুন রোগীর চেয়ে ৩ জন বেশি।

যশোরে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৭৭ জন মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। গতকাল বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ছিল ২৫১ জন। সিভিল সার্জন দিলীপ রায় বলেন, রোগীদের অধিকাংশ কেশবপুর, মনিরামপুর, বাঘারপাড়া ও চৌগাছা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের। অধিকাংশের বয়স ২০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। আক্রান্ত রোগীরা মূলত খালে, বিলে ও মাঠে কাজ করে। কর্মস্থলেই তারা মশায় আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে।

যশোর শহরে পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং মশকনিধন কর্মকাণ্ড পরিচালনার ফলে মশা ও ডেঙ্গুর প্রকোপ কমেছে বলে সিভিল সার্জন মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘গ্রামে অভিযান চালিয়ে মশা মারা কঠিন। গ্রামের অনেকে বলেছেন, মশা মারার জন্য কলাবাগান বা কচুখেত তো ধ্বংস করতে পারব না।’

কুষ্টিয়ার গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর খবর পাওয়া যাচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও সিভিল সার্জন কার্যালয়

সূত্র জানিয়েছে, সদর উপজেলার খাজানগর ও পশ্চিম আবদালপুর, ভেড়ামারা, কাজীহাটা ও দৌলতপুর উপজেলার অন্তত ৩০টি গ্রামে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। দৌলতপুরের দাঁড়পাড়াতেই আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ ছাড়িয়েছে। এসব এলাকার ঝোপঝাড় ও আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়ির আশপাশে ফগার মেশিন দিয়ে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। তবে কাজ হচ্ছে না।

শহরের চেয়ে গ্রামে মশা মারা কঠিন মন্তব্য করে ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল মারুফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই গরু পালন করা হয়। এতে গোয়ালঘরের পাশেই অপরিচ্ছন্ন জায়গায় পানি জমে থাকে। এ ছাড়া মানকচু বা কলাগাছে স্বচ্ছ পানি জমে থাকার সুযোগ আছে। কোথায় ওষুধ ছিটাব?’ তিনি আরও বলেন, কিছু এলাকায় মশারিও কম ব্যবহৃত হয়।

গতকাল বরিশালের শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল। তাদের ২৩ জনের সঙ্গে কথা বলেন প্রথম আলোর বরিশাল প্রতিনিধি। ১৮ জন স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, বাকি ৫ জনের ঢাকা ভ্রমণের ইতিহাস আছে।

বরিশালে স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের তথ্য পাওয়া গেলেও স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য–উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি কোন উপজেলায় আক্রান্ত বেশি, সেই তথ্যও নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য এখনো সংগ্রহ করা হয়নি। তবে বিভিন্ন উপজেলার আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

ডেঙ্গু জ্বরে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরে ও গ্রামে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, এটা প্রায় তিন সপ্তাহের প্রবণতা। এত দিন জানা ছিল, শহরে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে এডিস ইজিপটাই। বরিশাল, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরে জরিপ করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) দেখেছে, এসব এলাকায় এডিস অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশা আছে প্রচুর। এই প্রজাতির মশাও ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গতকাল ঢাকায় ভর্তি হয়েছিল ২২৮ জন আর ঢাকার বাইরে ৪৪৪ জন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নানা রকম নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমেছে। কিন্তু গ্রাম নিয়ে আলোচনা হয়নি কিংবা সামান্যই হয়েছে। গ্রামের দিকে নজরও সেভাবে দেওয়া হয়নি। এখন সময় এসেছে গ্রাম–শহরে সমান গুরুত্ব দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করার।

ঢাকার বাইরের সরকারি কর্মকর্তারা সঠিক দিকনির্দেশনাও পাচ্ছেন না। যশোরের সিভিল সার্জন দিলীপ রায় আইইডিসিআরের পরিচালক বরাবর চিঠি লিখে পরামর্শ চেয়েছেন। পরিস্থিতি অনুসন্ধানে একটি প্রতিনিধিদল পাঠানোর অনুরোধও করেছেন তিনি।

এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের পরিচালক  মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘যশোরের পরিস্থিতি আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়কে মশার লার্ভার নমুনা পাঠাতে বলেছি।’

আইইডিসিআর ২৮ হাজার ১৬১ জন রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, রোগীদের ৩৭ শতাংশ নারী এবং ৬৩ শতাংশ পুরুষ। আবার ২৬ হাজার ৫০৯ জনের তথ্যে তারা দেখেছে, আক্রান্তদের ৩২ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে।

গতকাল পর্যন্ত আইইডিসিআর ২০৩ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর তথ্য পেয়েছে। তাদের মধ্যে ১০১ জনের মৃত্যু পর্যালোচনা করেছে আইইডিসিআরের ডেঙ্গুতে মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি। কমিটি ৬০টি মৃত্যু ডেঙ্গুতে হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে তারা।

তবে প্রথম আলো এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে  ২১৫ জনের মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করেছে। রোগীর নিকটাত্মীয়, সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জন এবং হাসপাতালের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাছ থেকে এই মৃত্যুর তথ্য পেয়েছে প্রথম আলো