বগুড়ায় ১২টি থানায় হেল্প ডেস্ক দায়িত্বে নারী কর্মকর্তা

বগুড়া শহরের বাঁশবাড়িয়া এলাকার রিমা বেগম তাঁর প্রতিবন্ধী বোন নিখোঁজের অভিযোগ দিতে এসেছিলেন বগুড়া সদর থানায়। অভিযোগ কীভাবে লিখতে হবে, তা জানা ছিল না রিমার। থানায় পৌঁছানোর পর একজন নারী পুলিশ তাঁকে হেল্প ডেস্কে ডেকে নেন। সমস্যা শোনার পর অভিযোগ লিখে দেন। তিন দিনের মাথায় তাঁর বোনকে উদ্ধার করে পুলিশ।

শুধু রিমা বেগম নন, বগুড়ার ১২ থানায় স্থাপিত নারী ও শিশু সহায়তা হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে মিলছে নানা পুলিশি সেবা। জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার মামলা শূন্যের কোঠায় আনতে এবং আন্তরিকতা ও পেশাদারির সঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে বগুড়ার ১২টি থানায় নারী ও শিশু হেল্প ডেস্ক চালু হয়েছে। আর পুলিশি সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে এবং লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করতে থানায় থানায় কাজ করছে তরুণ স্বেচ্ছাসেবক দল।

স্থানীয় প্রশাসন সূত্র জানায়, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সহযোগিতায় বগুড়া, কক্সবাজার, জামালপুর ও পটুয়াখালীতে তিনটি করে থানায় নারী ও শিশু হেল্প ডেস্কের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞার উদ্যোগে মডেল কার্যক্রমের অংশ হিসেবে জেলার বাকি ৯টি থানায়ও এক বছর আগে নারী ও শিশু নির্যাতন অভিযোগ গ্রহণে হেল্প ডেস্ক কার্যক্রম চালু করা হয়। জেলার পাঁচ থানায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০৫ জন শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ছয় মাসে হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে ১২ থানায় ১ হাজার ৬৬৫টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে পারিবারিক নানা বিষয়াদি নিয়ে করা ১ হাজার ৪১৯টি অভিযোগ কাউন্সেলিং করে উভয় পক্ষের সমঝোতায় নিষ্পত্তি হয়েছে। অন্যদিকে, সমঝোতা হলেও অপরাধের ধরন অনুযায়ী ২২২টি অভিযোগ সাধারণ ডায়েরিভুক্ত করা হয়েছে। আর নারী ও শিশু ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির মতো আপস বা নিষ্পত্তির অযোগ্য ৩০৪টি অভিযোগ আমলে নিয়ে মামলা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নারী ও শিশু সহায়তা ডেস্ক স্থাপিত হওয়ায় থানায় অভিযোগ দিতে গিয়ে হয়রানি কমেছে। গুরুতর অভিযোগ ছাড়া বেশির ভাগ পারিবারিক বিরোধ মামলা ছাড়াই সন্তোষজনক নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে।

জেলা পুলিশ সূত্র আরও জানায়, গত জুলাই মাসে বগুড়া সদর থানায় নারী ও শিশু সহায়তা হেল্প ডেস্ক চালু হয়। এ পর্যন্ত এই থানায় হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতনের ৪২৫টি অভিযোগ জমা পড়েছে। জেলার থানার মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ। শহরের চেলোপাড়ার গৃহবধূ আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, তাঁর মেয়েকে নির্যাতন করায় জামাতার বিরুদ্ধে কয়েক দিন আগে থানায় হেল্প ডেস্কের সহায়তায় অভিযোগ করেন তিনি। থানায় অভিযোগ দেওয়ার পর পুলিশের তৎপরতায় জামাতা ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চান। পরে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন তিনি।

থানার ওসি এস এম বদিউজ্জামান বলেন, সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগ বেশি আসার অন্যতম কারণ শহরে জনসংখ্যা বেশি এবং গ্রামের লোকজনের চেয়ে শহরের লোকজন সচেতন বেশি। তা ছাড়া, শহরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক হোস্টেল থাকার কারণেও নারী নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটছে।

থানা-পুলিশ জানায়, হেল্প ডেস্কে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুসহ তাদের স্বজনেরা পুলিশি সেবা বা প্রতিকারের জন্য অভিযোগ করতে পারবেন। অভিযোগগুলো শোনার পর তা ধরন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নারী সহিংসতার শিকার হয়ে হতাশাগ্রস্ত নারীদের ব্যক্তিগত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যাতে করে তাঁরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন। এ ছাড়া, সহিংসতার শিকার নারীরা অভিযোগ করার পর ওই নারী যদি মামলা করতে চান, তাহলে তা মামলা হিসেবে নেওয়া হচ্ছে। এরপর মামলাটি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বলেন, জেলার ১২টি থানায় এক বছর ধরে নারী ও শিশু হেল্প ডেস্ক কার্যক্রম চলছে। এ জন্য প্রতিটি থানায় হেল্প ডেস্কে একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া, শতভাগ গোপনীয়তা রক্ষা করে নির্যাতিত নারী ও শিশুকে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে আইনি সেবা গ্রহণ করার প্রচারাভিযান চালাতে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কমিউনিটিভিত্তিক ১৪৮টি সচেতনতামূলক সমাবেশ করা হয়েছে।

এদিকে থানায় থানায় সহায়তা হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে পুলিশি সেবা গ্রহণে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করা ও লিঙ্গসমতা প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে যুব সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল এবং জেলা পুলিশের উদ্যোগে গত বুধবার জেলা পুলিশ লাইনস মিলনায়তনে এ আয়োজন করা হয়। যুব সমাবেশে নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি বন্ধসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা রোধে পুলিশের সঙ্গে একযোগে কাজ করার শপথ নেন তরুণ স্বেচ্ছাসেবীরা। বগুড়ায় ইয়ুথ ভলান্টিয়ারস ফর জেন্ডার ইকুয়ালিটি শীর্ষক এই যুব সমাবেশের উদ্বোধন করেন বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ।