নদীর জমিতে বাড়ি, ইটভাটা

মাগুরা শহরে নবগঙ্গার দুই পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে এসব স্থাপনা।  প্রথম আলো
মাগুরা শহরে নবগঙ্গার দুই পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে এসব স্থাপনা। প্রথম আলো

মাগুরা শহরের কোর্টপাড়ায় খাসজমিতে ৩০ বছর ধরে বসবাস করছেন পানু দাস। তাঁর টিনের চালার ঘরটি তৈরি হয়েছে নবগঙ্গা নদীর পাড় দখল করে। এমনকি বাড়ির একাংশে কিছু স্থাপনা রয়েছে একদম জলাধারের ওপর। সম্প্রতি বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশন নদী দখলদারদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাঁদের মধ্যে একজন তিনি। 

ঝাড়ুদার পানু দাস জানান, অন্য কোথাও ভিটেমাটি না থাকায় সরকারি জমিতেই মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করেছেন। একইভাবে তাঁর প্রতিবেশী প্রদীপ মণ্ডল, জালাল শেখ, গোলাপি বেগমসহ অনেকের নাম রয়েছে নদী দখলদারদের তালিকায়। যাঁদের একটি বড় অংশ ভিটেমাটিছাড়া। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৬ সালে একবার এ এলাকায় উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তখন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত করা হয়। 

পানু দাস জানান, সরকারি জমি হওয়ায় সেখানে পাকা স্থাপনা তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ কারণে তাঁরা সবাই টিনের চালার বাড়িতেই থাকছেন। পানুর বাড়ি ঘেঁষে রয়েছে একটি মন্দির। ইটের তৈরি একটি পাকা স্থাপনা এটি। এই মন্দিরও রয়েছে নদী দখলদারের তালিকায়। এটিসহ নবগঙ্গা নদীর জায়গা দখল করে তৈরি করা হয়েছে তিনটি মন্দির। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে উৎপত্তি হওয়া নবগঙ্গা নদী ২১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পড়েছে মাগুরায়। ঝিনাইদহ সদরের হাট গোপালপুর বাজার হয়ে যা মাগুরায় প্রবেশ করেছে। পরে শহরের নতুন বাজার হয়ে পূর্বাশা ঘাটে কুমার নদের সঙ্গে মিলে নবগঙ্গা বড় আকার ধারণ করেছে। তবে কুমারের সঙ্গে মেলার আগে নদী এমনিতেই সংকীর্ণ। এরপর দখল–দূষণে নবগঙ্গার এ অংশের অস্তিত্বই হুমকির মুখে। বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের তালিকা অনুযায়ী নবগঙ্গার মাগুরা অংশে দখলদার রয়েছেন অন্তত ৮০ জন। যার বেশির ভাগই শহরের কোর্টপাড়া, নিজ নান্দুয়ালী, নতুন বাজার, বাটিকাডাঙ্গা ও শিবরামপুরে নদীর সংকীর্ণ অংশে। প্রায় সবই দোকান ও বসতবাড়ি।

বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের প্রকাশিত তালিকায় দখলদার হিসেবে নাম রয়েছে পশু হাসপাতাল পাড়ার ব্যবসায়ী রজব আলীর। শহরের ঢাকা রোডে নদীর তীর ঘেঁষে লাবণী স্টিল কর্নার নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। এ বিষয়ে রজব বলেন, এ ধরনের একটি নোটিশ প্রশাসন থেকে তিনি একবার পেয়েছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের নভেম্বরে জেলা প্রশাসন থেকে জমি মাপা হয়েছিল। তখন তাঁর প্রতিষ্ঠান নদীর জায়গায় না বলে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এমন দাবি ওই ব্যবসায়ীর। 

সদর উপজেলায় আরও দখলদার রয়েছে মধুমতী নদীতে। তালিকা অনুযায়ী উপজেলার কছুন্দি, খোর্দ কছুন্দি ও বাগবাড়িয়া এলাকায় মধুমতীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে ছয়টি ইটভাটা। এর মধ্যে একজন খোর্দ কছুন্দির কে অ্যান্ড বি ব্রিকসের মালিক মো. মনিরুল খান। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভাটার পুরো জমি ব্যক্তিমালিকানাধীন। এর মধ্যে নদীর কোনো জমি নেই।’ 

মধুমতী, নবগঙ্গা ছাড়া দখলদার রয়েছে শ্রীপুর উপজেলার হানু নদে। সেখানে বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন স্থাপনাসহ ৪৫ জন দখলদারের নাম রয়েছে তালিকায়। 

কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত চিত্রা, ফটকি, মুচিখালী, কুমার ও মধুমতীর অন্যান্য অংশে আর কোনো দখলদার নেই। আর নদী দখলদারের এসব তালিকা করা হয়েছে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, এরপরও অনেক জায়গা দখল হয়েছে। এই তালিকা সম্পূর্ণ কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. ফরিদ হোসেন বলেন, তালিকাটি যাচাই–বাছাই করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। তারা প্রতিবেদন দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যাবে। 

জেলা প্রশাসক আলী আকবর প্রথম আলোকে জানান, প্রক্রিয়া অনুযায়ী শিগগিরই দখলদার উচ্ছেদে অভিযান চালানো হবে। তিনি বলেন, নদী বাঁচাতে ও শহরের সৌন্দর্যবর্ধনে দখলদার উচ্ছেদে কঠোর পদক্ষেপ নেবে জেলা প্রশাসন।