বরিশালের পল্লিতে আলো ছড়াচ্ছে জ্ঞানের পাঠশালা

জ্ঞানের পাঠশালায় সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: প্রথম আলো
জ্ঞানের পাঠশালায় সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: প্রথম আলো

১০ টাকা দিয়ে ভর্তি। এরপর বিনা পয়সায় চলে পড়ালেখা। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার প্রত্যন্ত পল্লি গুঠিয়া ইউনিয়নের ডহরপাড়া গ্রামে গড়ে উঠেছে ‘জ্ঞানের পাঠশালা’। নতুন প্রজন্মকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে ‘আমরা করব জয়’ স্লোগান ধারণ করে এ পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এটিতে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।

এ পাঠশালায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা, বিতর্ক শিখন প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা, মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি, সৃজনশীলতা বৃদ্ধির কৌশল, সংগীতচর্চা, ধর্মীয় শিক্ষা, প্রাথমিক চিকিৎসার ধারণাসহ সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়।

জ্ঞানের পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের ডহরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এবং বরিশাল সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. আরিফ মোল্লা। তিনি বলেন, বর্তমানে সব ক্ষেত্রে মেধার প্রতিযোগিতা চলছে। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা স্কুল-কলেজের লেখাপড়া দিয়ে ওই প্রতিযোগিতায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা টিকে থাকতে পারছে না। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ সব ক্ষেত্রে গ্রামের ছাত্ররা পিছিয়ে। তাই তাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞান অর্জনের বিষয় মাথায় রেখে ‘জ্ঞানের পাঠশালা’ নামে প্রতিষ্ঠানটি চালু করা হয়েছে।

এ উদ্যোগের সঙ্গে রয়েছে বরিশাল সরকারি শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষা ব্যাচেলর (বিএড) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী রাইসা রহমানসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া গ্রামের ১১ জন। অন্যরা হলেন আফরিন জাহান, ফয়সাল রাব্বি, মো. মঈন খান, মো. শামিম হাওলাদার, মো. বনি আমিন, মো. নাসিম খান, মো. রাহাত মিঞা, সানজিদা আক্তার ও মো. আসিফ। তাঁরাই সেখানে পড়ান।

৬ সেপ্টেম্বর জ্ঞানের পাঠশালার এক বছর পূর্তি উদ্‌যাপন করা হয়।

জ্ঞানের পাঠশালা পরিচালনা কমিটির সভাপতি রাইসা রহমান বলেন, উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য তিনি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। গ্রামের শিক্ষার্থীরা স্কুল–কলেজের পাঠ্যবই ও পাঠ্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে পড়াশোনা করেন। কিন্তু শহরের শিক্ষার্থীরা বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাধারণ জ্ঞানচর্চাসহ নানা কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ফলে তাঁরা ভালো অবস্থানে চলে যান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি। সে কষ্ট থেকে জ্ঞানের পাঠশালা করার ভাবনা মাথায় আসে। গ্রামের মেধাবীদের এখানে দক্ষ করে তোলা হবে।

জ্ঞানের পাঠশালার বছর পূর্তির অনুষ্ঠান। ছবি: প্রথম আলো
জ্ঞানের পাঠশালার বছর পূর্তির অনুষ্ঠান। ছবি: প্রথম আলো

উদ্যোক্তারা বলেন, তাঁদের নিজস্ব কোনো ভবন কিংবা শ্রেণিকক্ষ নেই। স্থানীয় সামাদিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসারএকটি শ্রেণিকক্ষে প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার জ্ঞানের পাঠশালায় শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। ইতিমধ্যে পাঠশালার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে একটি পাঠাগার। পাঠাগারে সংগ্রহে রাখা হয়েছে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক বইসহ নানা ধরনের গ্রন্থ। মাদ্রাসার একটি কক্ষে পাঠাগারটি গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে আছে এক হাজারের বেশি বই। ১১ জন উদ্যোক্তা টাকা জমিয়ে এ বইগুলো কিনেছেন। এখন অবশ্য কেউ কেউ বই উপহার দেয়। পাঠাগারটি সবার জন্য উন্মুক্ত। দিন দিন শিক্ষার্থীসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের বসার জায়গা ও শিক্ষা উপকরণের সংকট দেখা দিয়েছে। উদ্যোক্তারা নিজেরাই পড়ালেখাসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটান।

জ্ঞানের পাঠশালার ও স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী শিল্পী খানম বলে, স্কুলের লেখাপড়ার পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞানচর্চার জন্য এখানে ভর্তি হয়েছে। তাদের পাঠশালার শিক্ষকেরা বলেছেন, লেখাপড়া করে ভালো ছাত্র হওয়া সহজ। কিন্তু ভালো মানুষ হওয়া কঠিন।

ডহরপাড়া গ্রামের শিক্ষার্থী আবু তালহাজ বলেন, ‘আমি এই পাঠশালার একজন নিয়মিত ছাত্র। এখানে না এলে অনেক কিছুই অজানা থাকত। গ্রামে কোনো পাঠাগার ছিল না। জ্ঞানের পাঠশালার সঙ্গে পাঠাগার যুক্ত হওয়ায় আমরা পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছি।’

 ডহরপাড়া সামাদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুর রহমান বলেন, জ্ঞানের পাঠশালা সত্যিই এ এলাকায় জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে। এ পাঠশালার বার্তাটি যদি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সমাজ আলোকিত হবে, দেশ এগিয়ে যাবে। প্রত্যন্ত পল্লির পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারবে।

জ্ঞানের পাঠশালা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ভাইটশালী গ্রামের আফরিন জাহান বলেন, দিন দিন পাঠশালায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। তাই পাঠশালার কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

উজিরপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সহিদুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এ পাঠশালা সম্পর্কে জানি। নতুন প্রজন্মের মধ্য জ্ঞান বিতরণে এটি মহতী উদ্যোগ।’