মহাসড়কে বালুর হাট, ভোগান্তি

যশোর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়ক দখল করে বালু বিক্রির হাট বসেছে। যশোর উপশহরের ব্যস্ততম ওই মহাসড়কের দুই পাশে ট্রাকবোঝাই বালু রেখে বিক্রি করা হচ্ছে।

সার্বক্ষণিক বালুভর্তি ৩০ থেকে ৩৫টি ট্রাক রাস্তার ওপরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এতে ওই এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে এই মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন ও ট্রাক মালিক সমিতি ওই হাট নিয়ন্ত্রণ করে।

কয়েকজন বালু ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ১০ বছর ধরে এখানে বালু বিক্রি হচ্ছে। আগে দু-একটি ট্রাক এখানে এসে দাঁড়াত। লোকজন এসে ওই বালু কিনতেন। তখন কোনো হাট ছিল না। বছরখানেক ধরে যশোর জেলা ট্রাক, ট্রাক্টর, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকলরি শ্রমিক ইউনিয়ন এবং টার্মিনাল ট্রাক মালিক সমিতি এই বালুর হাট বসিয়েছে। এই হাটে ট্রাক রেখে বালু বিক্রি করলেই ট্রাকপ্রতি ২০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় দুই সমিতিকে। এতে প্রতিদিন চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়। ওই টাকা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন ও ট্রাক মালিক সমিতির মধ্যে ভাগাভাগি করা হয়। যে কারণে ওই হাট নিয়ে কেউ কথা বলতে পারেন না।

জানতে চাইলে যশোর জেলা ট্রাক, ট্রাক্টর, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ইনতাজ আলী বলেন, ‘দালালের মাধ্যমে আগে বালু কেনাবেচা হতো। তাতে ট্রাকচালকেরা কোনো লাভ পেতেন না। স্থানীয় লোকজন দালালি করে বালু বিক্রি করিয়ে দিয়ে লাভবান হতেন। টাকা না দিলে তাঁরা মাস্তানি করতেন। আমরা ওই হাটের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আমাদের চালকেরা এখন লাভবান হচ্ছেন। কেউ মাস্তানি করতে এলে আমরা রুখে দিই। এ জন্য ট্রাকপ্রতি ২০০ টাকা করে নেওয়া হয়। ওই টাকার অর্ধেক টার্মিনাল ট্রাক মালিক সমিতিকে দেওয়া হয়।’

সাইফুল ইসলাম নামের একজন বালু ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরাও জানি, এখানে বালু রাখায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু কী করব? বিকল্প জায়গাও তো নেই। সরকার আমাদের জন্য একটা জায়গা দিলে আমরা এই হাট এখান থেকে সরিয়ে নেব।’

সরেজমিন দেখা গেছে, খাজুরা বাসস্ট্যান্ড থেকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের যশোর প্রশিক্ষণকেন্দ্র পর্যন্ত এক কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। মহাসড়কের এই অংশ অত্যন্ত ব্যস্ততম ও জনগুরুত্বপূর্ণ। এই অংশ হচ্ছে যশোর শহরের প্রবেশদ্বার। এখানে নিউমার্কেট, ঢাকাগামী সব পরিবহনের কাউন্টার, ট্রাকস্ট্যান্ড ও মাইক্রোস্ট্যান্ড রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য দপ্তর রয়েছে।

খাজুরা ট্রাফিক আইল্যান্ডের পাশেই সড়কের পূর্ব পাশে বিশ্ব জাকের পার্টির জেলা কার্যালয়। দলীয় কার্যালয়ের সীমানায় সড়কের অনেক জায়গা রয়েছে। এ ছাড়া শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার পুরোপুরি সড়কের ওপরে স্থাপন করা হয়েছে। পাশের স্বপ্ন স্বাদ নামের একটি রেস্তোরাঁসহ অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে রাস্তার জায়গা। রাস্তার পশ্চিম পাশে অবৈধভাবে বহুতলবিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট নির্মাণ করা হয়। ২০০৮ সালের দিকে এই বিপণিবিতানের ভবনটি ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু আজও ওই ভবন অপসারণ করা হয়নি। রাস্তার ওপরেই ভবনটি ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। ওই ভবনের পাশেই বালুর হাট। এই হাট থেকে ২০০ গজের মতো সামনে ট্রাকস্ট্যান্ড। ২০০ থেকে ২৫০টি ট্রাক সব সময় রাস্তার ওপর রাখা হয়। কয়েক পা সামনে মাইক্রোস্ট্যান্ড। সেখানেও সব সময় ৩০-৪০টি মাইক্রোবাস রাস্তার পাশে পার্ক করে রাখা হয়। এই স্ট্যান্ডের পাশেই যশোর জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের একটি টংঘর রয়েছে। ওই ঘরের মধ্যে সব সময় ১০-১৫ জন শ্রমিক অবস্থান করেন। ওই টংঘরের সামনে ট্রাক, পিকআপ থামিয়ে টোকেনের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করা হয়। রাস্তার মধ্যে ট্রাক-পিকআপ দাঁড় করিয়ে চাঁদা আদায়ের কারণে সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। ঘটছে দুর্ঘটনা। এখান থেকে ২০ গজ সামনে রাস্তার ওপর ব্যক্তিমালিকানায় কয়েকজন নির্মাণসামগ্রী রেখে বিক্রি করেন। এর উল্টো দিকে রাস্তার জায়গায় হোটেল-রেস্তোরাঁ, মুদি দোকান, মোটর গ্যারেজসহ ২০টির মতো অবৈধ স্থাপন রয়েছে। নওয়াপাড়া মসজিদ পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশ অবৈধ দখলে চলে গেছে। এ ছাড়া এই এক কিলোমিটার অংশে রাস্তার পাশে পয়োনিষ্কাশনের কোনো নর্দমা নেই। একটু বর্ষা হলেই সড়কের দুই পাশে কাদাপানি জমে যায়। এরপরও সড়কটি কখনো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় বলে মনে হয় না। ফলে মশা-মাছির উপদ্রব বাড়ছে।

উপশহর ইউনিয়নের জায়গার মালিক জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সড়কের দখলদার উচ্ছেদে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তবে এ ব্যাপারে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের যশোর কার্যালয়ের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী দীপক সরকার বলেন, রাস্তা চলাচলের উপযোগী রাখা ও দখলদার উচ্ছেদের দায়িত্ব সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের।

জানতে চাইলে সওজ বিভাগ যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, রাস্তার পাশের অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। এরপর জেলা প্রশাসক বরাবর ওই তালিকা পাঠানো হবে। ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়ার পর পুলিশ সুপার সহায়তা করলে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে।

জানতে চাইলে উপশহর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আহসানুর রহমান বলেন, ‘ওই এলাকা ইউপির অধীনে থাকলেও পরিষদ কোনো টাকা পায় না। বালুর হাট নিয়ন্ত্রণ করে ট্রাক মালিক সমিতি। খাজুরা বাসস্ট্যান্ডে পরিবহনের অন্তত ১০০টি কাউন্টার রয়েছে। কিন্তু এখান থেকে আমরা কোনো টাকা পাই না। এ বিষয়ে পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতির সঙ্গে কথা বলেছি, কিন্তু তিনি জানিয়েছেন, পৌরসভায় তাঁরা টাকা দেন, ইউপিতে দেবেন না। তাহলে আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ মানুষের সেবা নিশ্চিত
করব কীভাবে?’