কর্মস্থলে যেতে নারীদের ভোগান্তি

যাতায়াত করতে গিয়ে গণপরিবহনে ভোগান্তিতে পড়তে হয় নারীদের। আসন না পেয়ে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন এক নারী। গতকাল রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
যাতায়াত করতে গিয়ে গণপরিবহনে ভোগান্তিতে পড়তে হয় নারীদের। আসন না পেয়ে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন এক নারী। গতকাল রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

কর্মজীবী মানুষের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নারী। কিন্তু সে অনুযায়ী নারীদের জন্য গণপরিবহনে তেমন সুবিধা নেই। তাঁদের বাসে উঠতে বাধা দেওয়া হয়, হতে হয় হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার। আবার নির্ধারিত সিট থাকে পুরুষের দখলে। সমস্যা সমাধানে সরকারেরও নজর কম।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা রেজওয়ানা হক (৩২) ধানমন্ডির একটি স্কুলে পড়ান। বাসে চলাচলকারী এই নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাকরি করতে গিয়ে রোজ নানা রকম ঝামেলার মুখোমুখি হই। তবে ঘরের বাইরে প্রধান বাধা যাতায়াতের সমস্যা। নারীবান্ধব গণপরিবহনের দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ বলছে, দেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ১ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার। এর বিপরীতে কর্মজীবী পুরুষ রয়েছেন ৪ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার। কিন্তু দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নারীদের জন্য বাস ২১টি আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৪টি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) চেয়ারম্যান মো. এহছানে এলাহী প্রথম আলোকে বলেন, ভোগান্তি কমাতে বাসের সংখ্যার পাশাপাশি নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বাড়ানো যায় কি না, বিষয়টি যাচাই করা হবে। তবে সংরক্ষিত আসনে যাতে নারীরা বসতে পারেন, সে জন্য এখন পর্যবেক্ষক দল কাজ করছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, কর্মজীবী নারীদের সকালে ও বিকেলে গণপরিবহনে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়। যানজটের সমস্যা তো আছেই। এ সময় বাসে উঠতে বাধা দেন বাসচালকের সহকারী। তারপরও খরচের কথা ভেবে দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা বা ঠেলাঠেলি করে বাসে ওঠেন নারীরা।

১২ সেপ্টেম্বর সকালে ফার্মগেটে ফুটপাতে এক তরুণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। বাস এলেই ছুটে যাচ্ছেন, বাসে উঠতে চেষ্টা করছেন, উঠতে না পেরে আবার পিছিয়ে আসছেন। তানিয়া আক্তার (২৩) নামের ওই তরুণী কুড়িলের একটি বিপণিবিতানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করেন। মাস শেষে আয় ছয় হাজার টাকা। তানিয়া বলেন, ‘রোজই এ রকম যুদ্ধ করে কাজে যাই। এর মধ্যেই হেলপার, পুরুষ যাত্রীরা গায়ে হাত দেয়, ইচ্ছা করে পায়ের ওপর জুতা দিয়ে চাপ দেয়। আবার যাতায়াতের সমস্যায় বাসায় ফিরে রান্না করতে দেরি হলে শাশুড়ির কথা শুনতে হয়।’

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক জরিপের তথ্য বলছে, দেশে গণপরিবহনে যাতায়াতকালে ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময়ে মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। ২০১৮ সালে প্রকাশিত জরিপটিতে ঢাকা, গাজীপুর ও সাভারের ৪১৫ জন নারী অংশ নেন। হয়রানির শিকার নারীদের ৮১ শতাংশ কোনো প্রতিবাদ করে না।

নির্ধারিত সিট পুরুষের দখলে

নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বাসে নয়টি আসন সংরক্ষিত রাখার নিয়ম রয়েছে। নিয়ম ভঙ্গ করলে রয়েছে জরিমানা ও দণ্ডের বিধান। তবে কোনো বাসে চারটি, কোনো বাসে ছয়টির বেশি সিট রাখতে দেখা যায়নি। সেগুলোতেও নারীরা বসতে পারছেন না। আবার সিটগুলো চালকের আসনের কাছাকাছি। যেখানে ইঞ্জিনের গরমে পা রাখা কষ্টকর। কোনো বাসে আবার ইঞ্জিনের ওপর আসন ফেলে নারীদের বসার ব্যবস্থা করা হয়।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী নাসিমা ইসলাম বলেন, নারীদের সিটে পুরুষ বসে থাকেন। উঠতে বললে উল্টো কথা শোনান। সাধারণ সিটে বসতে গেলে অনেক সময় পুরুষ যাত্রীরা বাধা দেন।

নারীর আর্থিক ক্ষমতায়নে যাতায়াতব্যবস্থার গুরুত্ব উল্লেখ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম প্রথম আলোকে বলেন, নারীরা অবর্ণনীয় কষ্ট ও অসহনীয় হয়রানি সহ্য করে যাতায়াত করছেন। অনেকেই না পেরে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। অথচ সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। সমাধানে নারীদের জন্য বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে বলে মত দেন তিনি।

বিআরটিসির মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. আমজাদ হোসেন জানান, বিআরটিসির অধীনে কর্মজীবী নারীদের জন্য ঢাকা শহরে ১৯টি ও চট্টগ্রাম শহরে ২টি বাস চলে। ঢাকায় বিভিন্ন এলাকা থেকে ছেড়ে আসা একটি বাদে সব কটি বাসের গন্তব্য মতিঝিল। অথচ দেশে বিআরটিসির সাধারণ বাস আছে ১ হাজার ১১০টি। এর মধ্যে ঢাকা শহরে চলে ৭৩০টি বাস। কর্মজীবী নারীদের বড় অংশের কাজের এলাকা ঢাকা।

গর্ভবতী নারীদের ভোগান্তি
ভিড় ঠেলে উঠতে হয় বলে বাসে চড়তে গিয়ে গর্ভবতী নারীদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বাসে উঠতে না উঠতেই জোরে টান দেন চালক। তখন নিজেকে সামলানো গর্ভবতী নারীর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। আবার চালক ও চালকের সহকারী বাসের ভেতরেই ধূমপান করেন। এতে সবার অসুবিধা হলেও গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি। এ কারণে গর্ভাবস্থায় চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে বলে জানালেন কয়েকজন নারী।

১২ সেপ্টেম্বর আগারগাঁও থেকে গর্ভবতী এক নারী বাসে ওঠেন; সঙ্গে তাঁর স্বামীও ছিলেন। বাসে উঠতে ও সিটে বসতে এই নারীর অন্যদের তুলনায় বেশি সময় লাগে। এতে বিরক্ত হন বাসচালকের সহকারী। এ অবস্থায় স্ত্রীকে নিয়ে বাসে ওঠায় মৃদু তিরস্কার করেন এক পুরুষ যাত্রীও।