যশোরে চার কারণে ডেঙ্গু রোগী বেশি

যশোরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ২৬৬ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন সাতজন। ঢাকার বাইরে যশোরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। যশোরের চিকিৎসক ও পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, চারটি কারণে যশোরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি। জেলার তিনটি উপজেলায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা, মাঝেমধ্যে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়া, যোগাযোগের ট্রানজিট পয়েন্ট হওয়া এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুবিধা বেশি থাকায় যশোরে রোগীরা ভিড় জমায়। ফলে স্থানীয়ভাবে যশোরে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বেড়েছে।

যশোর সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, যশোরে বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেওয়ায় এডিস মশা নিয়ে জরিপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। গত ১৯ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত এ জরিপ চালানো হয়। জরিপে নেতৃত্ব দেন জেলা কীটতত্ত্ববিদ আমিনুল হক। যশোর পৌর এলাকার ২০টি টায়ারের দোকান এবং কেশবপুর উপজেলার আলতাপোল, মনিরামপুর উপজেলার এড়ান্দা ও সদর উপজেলার বানিয়াবহু গ্রামে ১২০টি বাড়ি থেকে লার্ভা সংগ্রহ করে জরিপ দল। এর মধ্যে ৩৩টি স্থানে তারা এডিস মশার লার্ভা পায়। 

জেলা কীটতত্ত্ববিদ আমিনুল হক বলেন, সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া যায় যশোর শহরে। শহরের ঢাকা–যশোর মহাসড়কে ২০টি টায়ারের দোকানের মধ্যে ১৩টিতে লার্ভা পাওয়া যায়। জেলার অপর ৩টি গ্রামের ১০০টি বাড়ির মধ্যে ২০ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, এডিস মশার দুটি প্রজাতি—এডিস ইজিপটাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস। ডেঙ্গু ভাইরাস প্রধানত এডিস ইজিপটাইয়ের মাধ্যমে বেশি ছড়ায়। কম হলেও এডিস অ্যালবোপিকটাসও ডেঙ্গু ছড়ায়। গ্রামাঞ্চলে এডিস অ্যালবোপিকটাস বেশি। এডিস ইজিপটাই বেশি শহর এলাকায়। জরিপে জেলায় ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস ইজিপটাইর লার্ভা পাওয়া গেছে।

সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, ২১ জুলাই থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত যশোরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ২ হাজার ২৬৬ জন। এর মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে ২ হাজার ১ জন। মৃতের সংখ্যা ৫। বর্তমানে ২৬৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছে। এর মধ্যে যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৯৫ জন। এ ছাড়া জেলার ৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১৩৩ জন এবং বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে ৩৭ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। গত ২৪ ঘণ্টায় যশোরে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৮৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। 

এদিকে যশোরে এ পর্যন্ত মোট সাতজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন। এর মধ্যে গত ২১ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নড়াইলের কুড়িগ্রাম এলাকার রোকসানা পারভীন (৫৩), ২৭ আগস্ট মারা যান যশোরের মনিরামপুর উপজেলার রাজাবাড়ী গ্রামের রেবেকা বেগম (৫৫), ৩ সেপ্টেম্বর বাঘারপাড়ার ভাঙ্গুড়া গ্রামের শাজাহান আলী (৭০), ৭ সেপ্টেম্বর চৌগাছার বাগারদাড়ি গ্রামের আবদুল ওয়াদুদ (৪৫), ১০ সেপ্টেম্বর মনিরামপুরের কাশিমনগর গ্রামের জাহানারা বেগম (৪৫), ১১ সেপ্টেম্বর মনিরামপুরের হানুয়ার গ্রামের জাহিদা বেগম (৩৫) এবং সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর হৃদ্‌রোগে মারা যান মনিরামপুরের সালামতপুর গ্রামের মেহেরুন নেছা (৫০)। বাড়িতে মৃত্যুবরণ করায় চৌগাছার বাগারদাড়ি গ্রামের আবদুল ওয়াদুদ এবং মনিরামপুরের সালামতপুর গ্রামের মেহেরুন নেছাকে মৃতের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেনি জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। 

যশোরের সিভিল সার্জন দিলীপ কুমার রায় বলেন, শুরুর দিকে ঢাকা থেকে আসা ১৪০ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়। তাঁদের মাধ্যমে জেলায় এ রোগ বেশি ছড়িয়েছে। এ ছাড়া অতি সম্প্রতি মাঝেমধ্যে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত জলাবদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় সমস্যা বাড়ছে। জলাবদ্ধতা এডিস মশার প্রজননের পরিবেশ সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, ‘যশোরে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাতে চার দিন আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) বরাবর একটি চিঠি লিখেছিলাম। আজ (গতকাল) আবারও চিঠি লিখেছি। ফোনে তাঁর সঙ্গে কথাও হয়েছে। আশা করছি, দু-এক দিনের মধ্যে ঢাকা থেকে একটি প্রতিনিধি দল যশোরে আসবে। তখন পরিস্থিতি আরও ভালো করে বোঝা যাবে।’

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘মূলত শহর এলাকায় এডিস মশার বংশবিস্তার হয়। যশোর হচ্ছে যোগাযোগের ট্রানজিট পয়েন্ট। যানবাহন, বিশেষ করে ট্রেন, ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাসের মাধ্যমে রাজধানীকেন্দ্রিক এডিস মশার যশোরে বিস্তার ঘটেছে। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেন যশোর আসে। সেখানে থাকা ফাঁকা বগিতে মানুষের সঙ্গে এডিস মশাও ট্রান্সফার হতে পারে। ট্রানজিট পয়েন্ট বিধায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এমনকি ভারত থেকেও যানবাহন যশোরে আসে। ট্রাকের পেছনের অংশ, যেখানে পানি জমতে পারে এবং গ্যারেজে থাকা পুরোনো টায়ারেও এডিস মশার প্রজনন হয়ে থাকে। ফলে স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এ ছাড়া যশোরে ভালো চিকিৎসাসুবিধা থাকায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগীরা এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। তাদের মাধ্যমেও ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে।