মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা আতঙ্কে

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও অবৈধ অভিবাসীদের আটক করতে মালয়েশিয়া সরকার হঠাৎ অভিযান শুরু করায় দেশটিতে থাকা বাংলাদেশি কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বহু বাংলাদেশি গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে বন্ধ হওয়ার এক বছর পরও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নতুন করে চালু করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের কর্মীদের দ্বিতীয় প্রধান গন্তব্য মালয়েশিয়া।

মালয়েশিয়াপ্রবাসী সিলেটের বাসিন্দা জর্ডান সিং গত শনিবার বিকেলে কুয়ালালামপুর থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আগের মতো ব্লক রেইড (এলাকা বেছে বেছে অভিযান) দিয়ে বিদেশি শ্রমিকদের না ধরলেও পথে পথে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে দেশটির পুলিশ। সঙ্গে পাসপোর্ট না পেলেই আটক করা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি কর্মীদের পাসপোর্ট নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকে। রাস্তায় আটক হওয়ার ভয়ে অনেকে অভিবাসন বুথে (সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিতে চান যাঁরা) পর্যন্ত যেতে পারছেন না। তাঁদের লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে।

>এক বছর পরও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নতুন করে চালু করা সম্ভব হয়নি।
মালয়েশিয়ায় থাকা অবৈধ বাংলাদেশির সংখ্যা দেড় লাখ থেকে দুই লাখ।
মালয়েশিয়ায় এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ২৭২ জন বাংলাদেশি আটক।

বৈধ কাগজপত্র সঙ্গে নেই এমন বিদেশি শ্রমিকদের নির্বিঘ্নে নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে গত জুলাই মাসে দ্য ব্যাক ফর গুড প্রোগ্রাম বা মঙ্গলের জন্য ফিরে যাওয়া কর্মসূচি শুরু করে মালয়েশিয়া সরকার। এর আওতায় অবৈধ কর্মীরা ১ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে ফেরার সুযোগ পাবেন। কিন্তু এরই মধ্যে ধরপাকড় চলছে।

মালয়েশিয়ার বহির্গমন বিভাগের বরাত দিয়ে দেশটির গণমাধ্যম দ্য স্টার অনলাইনের এক খবরে গত শনিবার বলা হয়েছে, ক্যামেরুন হাইল্যান্ড এলাকার সাতটি সবজি ও ফুলের খামারে অভিযান চালিয়ে ১২ বাংলাদেশিসহ ৩৯ জন বিদেশি শ্রমিককে আটক করা হয়েছে। বৈধ নিয়োগপত্র ছাড়া কাজ করার অভিযোগে তাঁদের আটক করা হয়েছে।

সাধারণ ক্ষমা চলাকালীন মালয়েশিয়ায় ধরপাকড় চলার কথা নয় বলে প্রথম আলোকে জানান প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রৌনক জাহান। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ধরপাকড়ের কোনো অভিযোগ তাঁরা পাননি। হাইকমিশনের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

বিভিন্ন দেশের ২০ থেকে ৩০ লাখ অবৈধ অভিবাসী মালয়েশিয়ায় রয়েছেন বলে মনে করছে অভিবাসন খাত নিয়ে কাজ করা এশিয়ার ২০টি দেশের আঞ্চলিক সংগঠন ক্যারাম এশিয়া। তবে বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা কত, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রমবিভাগ বলছে, সংখ্যাটি কয়েক হাজার হতে পারে। তবে এই হিসাবের সঙ্গে একমত নন অভিবাসন খাতে কাজ করা দেশের উন্নয়ন সংস্থা ও ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মত, মালয়েশিয়ায় থাকা অবৈধ বাংলাদেশির সংখ্যা দেড় লাখ থেকে দুই লাখের কম হবে না।

মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশিরা জানান, একজন বৈধ কর্মী ঘণ্টায় ৮ থেকে ১০ রিঙ্গিত বা ১৬০ থেকে ২০০ টাকা আয় করলেও অবৈধ কর্মী আয় করেন মাত্র ৬০ থেকে ৮০ টাকা। 

মালয়েশিয়ার বহির্গমন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ২৭২ জন বাংলাদেশিকে আটক করা হয়েছে। মূলত জুলাই থেকে অবৈধ অভিবাসীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে অভিবাসন পুলিশ। কয়েক শ বাংলাদেশি পুলিশের হাতে আটক হয়ে কারাগারে গেছেন। 

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বহির্গমন বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছর মালয়েশিয়া থেকে ৭ হাজার ৩৭২ বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। আর এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ফিরেছেন প্রায় আড়াই হাজার অবৈধ অভিবাসী। 

কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সেলর মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, বিদেশি শ্রমিকদের সাধারণ ক্ষমার সঙ্গে বিদেশি কর্মী আটকের বিষয়টি সম্পৃক্ত নয়। মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ বহির্গমন আইনসহ নানা কারণে সন্দেহভাজন লোকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। তিনি বলেন, সাধারণ ক্ষমার আওতায় দেশে ফিরতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেকেই যোগাযোগ করছেন। ১ আগস্ট থেকে প্রতিদিন গড়ে ২০০ কর্মী হাইকমিশনে আসছেন। মূলত যাঁদের কাছে পাসপোর্ট, নিয়োগপত্র বা কোনো কাগজপত্র নেই, তাঁরাই শুধু হাইকমিশনে এসে দেশে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ সংগ্রহ করছেন। 

সাধারণ ক্ষমার আওতায় স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার সুযোগ দিতে ১৮ জুলাই ৫ মাসের সময় বেঁধে দেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন বিন মোহাম্মদ ইয়াসিন। মালয়েশিয়ার বহির্গমন বিভাগের আওতায় এ জন্য দেশজুড়ে ৮০টি কাউন্টার খোলা হয়েছে। অবৈধ অভিবাসীরা প্রতিদিন বহির্গমন কার্যালয়ের কাউন্টারে উপস্থিত হয়ে আউটপাস সংগ্রহ করছেন। প্রত্যেক অভিবাসীকে ৭০০ রিঙ্গিত (১৪ হাজার টাকা) জরিমানা পরিশোধ করতে হচ্ছে।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অবৈধ কর্মীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল মালয়েশিয়ার সরকার। দেশটির সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, ওই সময় ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৬২৭ জন বাংলাদেশি আবেদন করেন। তবে বাংলাদেশ হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বৈধ হতে আবেদন করেন প্রায় ৬ লাখ। শেষ পর্যন্ত বৈধ হওয়ার সুযোগ পান ২ লাখ ৮০ হাজার ১১০ জন। 

মালয়েশিয়ার মানবাধিকার সংগঠন নর্থ সাউথ ইনিশিয়েটিভের পরিচালক অ্যাড্রিয়ান পেরেরা গতকাল বিকেলে কুয়ালালামপুর থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও এ ধরনের অভিযান চালানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। বৈধ কাগজপত্র না থাকা বিদেশি শ্রমিকদের মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ জাতীয় নিরাপত্তার সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। যে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিদেশি শ্রমিকেরা বৈধ কাগজপত্র ছাড়া মালয়েশিয়ায় আসেন, তাঁদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, উল্টো তাঁদের প্রশ্রয় দেওয়া হয়। আর নিরীহ শ্রমিকেরা পদে পদে বিড়ম্বনা এবং অনিশ্চিত জীবনের মুখে পড়েন।

বাজার খোলেনি এক বছর পরও 

মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের একটি সংঘবদ্ধ চক্রের অনৈতিক ব্যবসা পরিচালনার কারণে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে দেশটিতে নতুন কর্মী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। অবশ্য তখন সব দেশ থেকেই শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয় দেশটির সরকার। ১২ সেপ্টেম্বর নেপালের সঙ্গে কর্মী নিয়োগে চুক্তি করেছে মালয়েশিয়া। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সে সুযোগ নিতে পারেনি।

কর্মী নিয়োগ বন্ধ হওয়ার আগপর্যন্ত মালয়েশিয়ার একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী মহলকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির (জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান) একটি চক্র সেখানকার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করছিল। গত বছর দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগে সংঘবদ্ধ চক্রের যুক্ততা আর বাড়তি টাকা নেওয়ার প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। 

২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টে মাহাথির মোহাম্মদের সভাপতিত্বে বিদেশি শ্রমিক ব্যবস্থাপনা–বিষয়ক বিশেষ কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে বেশ কয়েকবার বৈঠক শেষেও বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় নতুন করে কর্মী নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি। তবে গত এক বছরে যেসব কর্মী মালয়েশিয়ায় কাজের জন্য গেছেন, তাঁদের সবাই নিষেধাজ্ঞার আগেই কাজের অনুমতিপত্র পেয়েছিলেন। 

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে জি টু জি প্লাস (সরকারি-বেসরকারি) সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর এক বছর পর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া যান ২ লাখ ৭৫ হাজার ৭১৪ জন। সরকারি হিসাবে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর খরচ ছিল সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা। কিন্তু এজেন্সিগুলো নিত জনপ্রতি তিন থেকে সাড়ে লাখ টাকা। 

যে ১০টি এজেন্সি মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাত তারা হলো-ক্যারিয়ার ওভারসিজ, এইচএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স, সানজারি ইন্টারন্যাশনাল, রাব্বী ইন্টারন্যাশনাল, প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড, আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম ও আল ইসলাম ওভারসিজ।

মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার বন্ধের পর অভিযুক্ত ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি নতুন করে কর্মী নিয়োগ শুরুর আলোচনার মধ্যেই ওই সিন্ডিকেট কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজ পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। 

নতুন করে বাজার উন্মুক্ত হলে কোনো সিন্ডিকেট থাকবে না বলে জানান প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রৌনক জাহান। আর বাজার বন্ধের জন্য দায়ী এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। 

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি কর্মী রয়েছে সৌদি অরবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদির পরই মালয়েশিয়ায় বেশিসংখ্যক কর্মী গেছেন। ২০১৮ সালে সৌদি আরবে গেছেন ২ লাখ ৫৭ হাজার। আর মালয়েশিয়ায় গেছেন ১ লাখ ৭৬ হাজার। কাতারে গেছেন ৭৬ হাজার কর্মী।

অভিবাসন–বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর পরিচালক সিআর আবরার বলেন, মালয়েশিয়ার মতো সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার অন্য দেশগুলো দখল করে নিলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যারা এই শ্রমবাজার বন্ধের জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো সরকারি কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। কোনো শ্রমবাজারে যাতে সিন্ডিকেট গড়ে না ওঠে, সেদিকে সরকারের নজর থাকতে হবে।