কড়াইল বস্তির চাঁদার ১০ কোটি যায় নেতাদের পকেটে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

গুলশান লেকের ওপারে দেশের বৃহত্তর বস্তি কড়াইল। সেখানে সরকারি জমিতে গড়ে উঠেছে ২৫ হাজারের মতো বস্তিঘর। প্রতিটি ঘরে আছে গ্যাস-বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ। বস্তিবাসীরা জানান, একেকটি ঘরের মাসিক ভাড়া তিন থেকে চার হাজার টাকা। মাসে ভাড়া আসে ১০ কোটি টাকা। ভাড়ার এই টাকা যায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও তাঁতী লীগের নেতা-কর্মীদের পকেটে।

এর বাইরে আছে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ থেকে আয়। বস্তিবাসীরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের অন্তত ৪০ জন এসব নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নাছির ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মফিজউদ্দিনের লোক বলে পরিচিত। নাছির বনানী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও মফিজউদ্দিন ১৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি।

মো. নাছির চাঁদাবাজির এসব অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, কড়াইল বস্তিতে অবৈধ সংযোগ থেকে যাঁরা টাকা তোলেন, তাঁরা ভাড়াটে আওয়ামী লীগার।

আর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মফিজউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার নাম ভাঙিয়ে কিছু লোক এসব আকাম করেছে। এদের কেউ কেউ আমার সিল ও সই পর্যন্ত জাল করেছে।’

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, গণপূর্ত বিভাগের প্রায় ৯৭ একর জমিতে মহাখালীর কড়াইল বস্তি। নিচু জমি ভরাট করে ধীরে ধীরে সেখানে বস্তি গড়ে ওঠে। বস্তিটির মূল নাম কড়াইল হলেও নিয়ন্ত্রণকারীরা এই বস্তিকে ১০ ভাগ করেছেন। সেগুলো হলো কুমিল্লা পট্টি, বেলতলা বস্তি, গোডাউন বস্তি, পশ্চিমপাড়া ও পূর্বপাড়া বস্তি, উত্তরপাড়া বস্তি, বাইদাপাড়া বস্তি, মোসা বস্তি, বউবাজার ও এরশাদনগর বস্তি।

দেখা যায়, দুই পাশে বাঁশ ও টিনের ছাপরায় একতলা ও দোতলা ঘর। আধা পাকা ঘরও আছে। ছয় বাই সাত ফুটের একটি ঘরে খাট পাতা। তার চারপাশ মালামালে ঠাসা। কিছু ঘরে আছে টিভি, ফ্রিজ ও ফ্যান। ঘরে ঘরে বিপজ্জনকভাবে দেওয়া বিদ্যুতের সংযোগ। আছে কাঁচাবাজার ও রেস্তোরাঁ। ভেতরে প্লাস্টিক ও লোহার পাইপ দিয়ে নেওয়া হয়েছে গ্যাসের সংযোগ। ট্রান্সমিটার থেকে সরাসরি তার টেনে বিদ্যুতের সংযোগ নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু বৈধ সংযোগও আছে সেখানে।

বেলতলা আদর্শ নগরের বস্তির রেহানা বেগম বলেন, মাস শেষে নেতা নায়েব আলী বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংযোগের জন্য হাতে লেখা স্লিপ দিয়ে ৭০০ এবং বিদ্যুতের জন্য ৫০০ টাকা নেন।

ছাপরায় রেস্তোরাঁ চালাচ্ছেন জুবেদা বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের দুই চুলার সংযোগের জন্য দেড় হাজার ও আরেকটি চুলার জন্য এক হাজার টাকা নেন নেতারা।

আরেক রেস্তোরাঁমালিক রাশেদা বেগম বলেন, মাসে গ্যাস-সংযোগের জন্য ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং বিদ্যুতের জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা নেন বউবাজার বস্তির আওয়ামী লীগের নেতা।

মহাখালী অঞ্চলের ঢাকা ইলেকট্রিক কোম্পানির (ডেসকো) উপবিভাগীয় প্রকৌশলী এ বি এম মাসুম বস্তিতে অবৈধ সংযোগ থাকার কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, কড়াইল বস্তিতে মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।

সরেজমিনে স্থানীয় বাসিন্দা ও বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বস্তি যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁদের মধ্যে মোসা বাজারে চাঁদাবাজি করেন বনানী থানা শ্রমিক লীগের সভাপতি জুয়েল শিকদার, ১৯ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদুল, ১৯ নম্বর স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মো. মোস্তফা ও যুবলীগের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড ২ নম্বর ইউনিটের প্রস্তাবিত কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম ওরফে রফিক, ১৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনজুর হক। বনানী থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মাশুক আহমেদ ওরফে ল্যাংড়া মাসুক, ১৯ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সম্পাদক নুরুজ্জামান ওরফে নুরু ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর ইউনিটের সভাপতি মোহাম্মদ আলী উল্লেখযোগ্য।

এসব নেতার মধ্যে ১০ জনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা সবাই দাবি করেন, এসব অভিযোগ ঠিক নয়।

তবে তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (ঢাকা উত্তর) রানা আকবর হায়দারি প্রথম আলোকে বলেন, পুরো কড়াইল বস্তিই চলছে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দিয়ে। সেখানে অভিযান চালাতে গিয়ে হামলারও শিকার হতে হয়। তিনি বলেন, এর পেছনে প্রভাশালীরা জড়িত। যে কারণে অভিযান চালিয়ে লাভ হয় না।

জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহা. নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, কড়াইল বস্তি সিটি করপোরেশনের অধীনে। তাই এখানে সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অবৈধ আয়ের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সুবিধাভোগীদের বিতাড়ন করা গেলেই এলাকায় স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে।