তান্ত্রিক-কবিরাজের লিফলেটে সব সমস্যা 'সমাধানের আশ্বাস'

বর্তমানে রাজধানী ঢাকা এমন ধরনের তান্ত্রিক ও কবিরাজের লিফলেটে ভরে গেছে। একেক গলি একেকজনের দখলে থাকে। কোনো কোনো লিফলেট রঙিন। ছবি: সংগৃহীত
বর্তমানে রাজধানী ঢাকা এমন ধরনের তান্ত্রিক ও কবিরাজের লিফলেটে ভরে গেছে। একেক গলি একেকজনের দখলে থাকে। কোনো কোনো লিফলেট রঙিন। ছবি: সংগৃহীত

‘মাঝরাতে জিন, জিন চিনেন? জিনে থাপ্পড় দিলে কানে এমুন ব্যথা হয়। জিনে থাপ্পড় দিসিল কি না আমি দেখব। চিকিৎসা করতে চাইলে একটা রক্তজবা ফুল, ১০১টি মোমবাতি ও তিন কেজি দুধ লাগব। কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠাইতে পারেন জিনিস। আর ইমার্জেন্সি হইলে লোক পাঠাইয়া কাজ করাইয়া দিমু। পরে আমারে খুশি করবেন। বিকাশ নাম্বার দিতাছি, বিকাশে জিনিসের দাম ১ হাজার ২৫ টাকা পাঠাইয়া দিলেই হইব। দাদা, টাকাটা একটু তাড়াতাড়ি পাঠাইবেন। সন্ধ্যা হইলে রক্তজবা জোগাড় করতে পারুম না। তিনটা রোগী আছে, তাড়াতাড়ি পাঠাইলে একসঙ্গে ধরুম।’

এ কথাগুলো বলেছেন তান্ত্রিক অরুণ বৈদ্য। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শুভ রহমান রাজধানীর কারওয়ান বাজারে একটি দেয়ালে সাঁটানো লিফলেট দেখে অরুণ বৈদ্যের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন। শুভ বলেছিলেন যে তাঁর কানে ব্যথা। এরপর এই তান্ত্রিক কানের ব্যথার কারণ ও ব্যথায় করণীয় বাতলে দিলেন এভাবে। শুভ জানান, ঢাকা শহরে বিভিন্ন তান্ত্রিকের লিফলেটে ভরে গেছে। তিনি ইচ্ছে করেই ফোন দিয়েছিলেন। তবে একবার ফোন দেওয়ার পর বারবার এই তান্ত্রিক বিকাশে টাকা পাঠানোর জন্য ফোন দিতে থাকেন।

বর্তমানে রাজধানী ঢাকা এমন ধরনের তান্ত্রিক ও কবিরাজের লিফলেটে ভরে গেছে। একেক গলি একেকজনের দখলে থাকে। কোনো কোনো লিফলেট রঙিন। কোনোটায় কবুতর, সাপ, গাছ, কঙ্কালসহ নানা কিছুর ছবি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও এই তান্ত্রিকদের ভিডিও দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে এই প্রতিবেদক রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শেখেরটেক থেকে তিনজন তান্ত্রিকের তিনটি লিফলেটের ছবি তুলেছেন। লিফলেটগুলো লাগানো হয় একটির ওপর আরেকটি।

আরেক তান্ত্রিকের নাম জসদা গুরু মা। নাম নারীর মনে হলেও এই তান্ত্রিক একজন পুরুষ। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা নেই—এ কারণ দেখিয়ে ফোন দেওয়া হলে তিনি সরাসরি দেখা করতে বলেন। তবে এর জন্য গুরু মার খরচের জন্য হাদিয়া লাগবে বলেও জানান। এ রোগের চিকিৎসায় দুটি গামছা লাগবে, যার দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা। তবে গামছা কিনে দিতে হবে না, তান্ত্রিক নিজেই দেবেন।

যে নারী জসদা গুরু মাকে ফোন দিয়েছিলেন, তিনি প্রথম আলোকে জানান, গামছার কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তান্ত্রিক দেখা করতে বলেন। ওই তান্ত্রিক বলেন, ‘গামছা দিয়ে কী করতে হবে, তা আমি বইলা দেব। সাক্ষাতে ছাড়া বলা যাবে না। কাজ হলে আপনে বকশিশ দিবেন। আর কিছু লাগবে না।’ এই তান্ত্রিকের দাবি, সাভারে তাঁর আস্তানায় ঢাকার ধানমন্ডি, উত্তরাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে গাড়ি নিয়ে লোকজন যান। লাখ লাখ মানুষকে তিনি চিকিৎসা দিয়েছেন। চিকিৎসা করতে সময় লাগে এক ঘণ্টা আর ওষুধে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাজ হয়।

এ ধরনের আরেক তান্ত্রিক আরবি বেগম। প্রথম আলোকে আরবি বেগম বলেন, তিনি কুমিল্লায় বসে চিকিৎসা করেন। তবে তাঁর রোগী আছে সারা দেশে। বহু বছর ধরে কাজ করছেন। একসঙ্গে দু–তিনটি রোগের চিকিৎসা করাতে চাইলে শুধু খরচটা বাড়ে। মুঠোফোনেই চিকিৎসা করে দিতে পারেন তিনি।

ঢাকা সিটি করপোরেশনের অরডিন্যান্স অনুযায়ী, করপোরেশনের অনুমতি ছাড়া এবং নির্ধারিত ফি না দিয়ে লিফলেট, পোস্টার লাগানো অপরাধ। বিষয়টি দেখে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল–৫–এর সহকারী প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. মফিজুর রহমান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বললেন, অনুমতি ছাড়া কেউ লিফলেট বা পোস্টার লাগালে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিধান আছে। তান্ত্রিক বা কবিরাজদের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ পেলে বিভাগের পক্ষ থেকে অবশ্যই মামলা করা হবে।

সাভারের রোজানা গুরুমা নিজের পরিচয় দেন ‘তান্ত্রিক কবিরাজ’ হিসেবে। লিফলেট অনুযায়ী, তাঁর আদি বাড়ি ভারতে। তাঁর লিফলেটে আছে সাপের ছবি, আর সাপের মুখেই দেখা যায় একজন পুরুষ ও একজন নারীর ছবি। জিন-পরির আসর থেকে রক্ষা করা, স্বামী-স্ত্রীর অমিল, বাতের ব্যথা, পারিবারিক অশান্তি দূর করা, কিছু অসাধ্য কাজকে সাধ্য করাসহ একাধিক বিষয়ে এই তান্ত্রিক ‘সেবা ও সুপরামর্শ’ দেন। লিফলেটে সাভারের ঠিকানা দেওয়া আছে।

এই তথাকথিত তান্ত্রিক বা কবিরাজদের খপ্পরে পড়ে সাধারণ মানুষ বিপদে পড়ছে। পুলিশ সদর দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এভাবে লিফলেট লাগানোর জন্য পুলিশ কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। তবে এই তান্ত্রিক বা কবিরাজের খপ্পরে পড়ে কেউ প্রতারিত হলে বা নির্যাতনের শিকার হলে তখন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ–উপাচার্য অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বললেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যা গ্রহণ করেনি এবং যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তা অবশ্যই অবৈধ। তান্ত্রিক বা কবিরাজের লিফলেট ছেপে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। শুধু যে লিফলেট ছাপাচ্ছে তা–ই নয়, প্রকাশ্যে বিভিন্ন সময় ওষুধও বিক্রি করছে। অনেক সময় বেসরকারি টেলিভিশনের স্ক্রল বা বিজ্ঞাপনেও তা প্রচার করা হচ্ছে। ফেসবুকেও চলছে প্রচার। এ বিষয়টি অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেখতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব। তিনি বলেন, তান্ত্রিক–কবিরাজ নামধারীরা লিফলেট ছেপে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে বা প্রতারণার প্রস্তুতি নিচ্ছে—এভাবেও বিষয়টিকে দেখা যায়। প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষই বেশি প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এই মানুষদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।