কতটি ল্যাপটপ খোয়া গেছে, জানে না ইসি

চট্টগ্রামের জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অধীন ২১ উপজেলা বা থানা কার্যালয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) নিবন্ধনের কাজ হয়। এসব কার্যালয়ে মোট কতটি ল্যাপটপ আছে এবং এর মধ্যে কতটি খোয়া গেছে, তা এখনো নিশ্চিত করে জানে না নির্বাচন কমিশন (ইসি) বা জেলা নির্বাচন কার্যালয়।

তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত এনআইডির নিবন্ধনের কাজে ব্যবহৃত পাঁচটি ল্যাপটপ চুরি হওয়ার কথা জানা গেছে। এর মধ্যে চারটি ২০১৪ সালে চুরি হয় চন্দনাইশ কার্যালয় থেকে। আরেকটি কবে ও কোথায় থেকে চুরি হয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি। চুরি হওয়া এসব ল্যাপটপ জাতীয় তথ্যভান্ডারের (সার্ভার) সঙ্গে যুক্ত। এনআইডি নিবন্ধনের কাজে এগুলোর ব্যবহার ঠেকাতে এত দিনেও কোনো ধরনের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, এসব ল্যাপটপ গত মাস পর্যন্ত চালু ছিল এবং এগুলো রোহিঙ্গাসহ নানা ভুয়া এনআইডি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। এমন একটি ল্যাপটপ গত সোমবার উদ্ধারও হয়েছে। 

ইসির একটি কারিগরি দল এরই মধ্যে চট্টগ্রামে এসে তদন্ত শুরু করেছে। তাদের মতে, খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ ব্যবহার করে কতটি ভুয়া এনআইডি তৈরি করা হয়েছে, তা বের করা সহজ নয়। তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ইসির আইটি বিশেষজ্ঞ মো. শাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আগে ল্যাপটপ খোয়া গেলে তা দিয়ে যেকোনো জায়গা থেকে কাজ করা যেত। ইসির ল্যাপটপগুলোয় একই ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করা হতো, যার জন্য কোনো কর্মচারী সেই সফটওয়্যার অফিস থেকে সংগ্রহ করে সহজে চুরি যাওয়া ল্যাপটপে ব্যবহার করতে পারতেন। এখন ল্যাপটপ খুলতে ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়া হয়েছে। চুরি যাওয়া ল্যাপটপে কাজ করা আর সম্ভব হবে না। 

জানা গেছে, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ফিঙ্গার প্রিন্ট (আঙুলের ছাপ) দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়েছে। এর আগে পাসওয়ার্ড দিয়ে ল্যাপটপ খোলা হতো।

যেভাবে বিষয়টা সামনে এল

গত ২২ আগস্ট লাকী নামের এক নারী চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে এনআইডির স্মার্ট কার্ড তুলতে গেলে কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ওই নারী রোহিঙ্গা এবং টাকা দিয়ে এনআইডি করিয়েছেন। এই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে ধরা পড়ে ইসির ডবলমুরিং থানার অফিস সহায়ক (পিয়ন) জয়নাল আবেদীন একটি ল্যাপটপ চুরি করে নিজ বাসায় বসে টাকার বিনিময়ে বিভিন্নজনকে এনআইডি তৈরি করে দিচ্ছেন। গত সোমবার রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার ও ল্যাপটপটি উদ্ধার করা হয়। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, এই পিয়ন জমি কিনে চট্টগ্রামে রাতারাতি পাঁচতলা বাড়িও বানিয়েছেন। তবে এই ল্যাপটপ জয়নাল কোথা থেকে চুরি করেছেন, গতকাল পর্যন্ত তা বলেননি।

এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেস বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, আদালত গতকাল জয়নালের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। তাঁকে হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জয়নালের সঙ্গে গ্রেপ্তার দুই আসামি বিজয় দাস ও তাঁর বোন সীমা দাসের এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। 

হারানো ল্যাপ​টপের সন্ধানে ইসি

চট্টগ্রামের কোন কার্যালয় থেকে কত ল্যাপটপ খোয়া গেছে, সেটা জানতে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে ইসি। কোনো ল্যাপটপ খোয়া গেছে কি না; গেলে কতটি গেছে সেটা জানার জন্য উপজেলা কার্যালয়গুলোকে নির্দেশ দিয়েছে রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির প্রধান ও ইসি সচিবালয়ের উপসচিব মো. খোরশেদ আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আজকালের মধ্যে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। 

>পাঁচটি ল্যাপটপ চুরির তথ্য জানা গেছে
এগুলোর মধ্যে চারটি ২০১৪ সালে চুরি হয়
এ চারটি ভুয়া এনআইডি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়

খোরশেদ আলম ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, তাঁর জানামতে ২০১৪ সালে চন্দনাইশ কার্যালয় থেকে চারটি ল্যাপটপ খোয়া গেছে। এ বিষয়ে তখন চন্দনাইশ থানায় একটি মামলা করা হয়। সেই মামলা এখনো চলমান। তবে আসামিরা জামিনে বাইরে আছেন। 

এই মামলার সর্বশেষ কী অবস্থা গতকাল জানতে চাইলে চন্দনাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেশব চক্রবর্তী কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘পুরোনো বিষয়। এটা কীভাবে আছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে বলা সম্ভব নয়।’

এই চারটি ল্যাপটপ ছাড়া আরও একটি ল্যাপটপ চট্টগ্রাম থেকে হারানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন খান। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, অপর ল্যাপটপটি চট্টগ্রামের কোথায় থেকে হারিয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো রেকর্ড নেই। পাঁচলাইশের বলে কেউ কেউ বলছে। জয়নালের কাছ থেকে উদ্ধার করা ল্যাপটপটি এই পাঁচটির একটি কি না, তাও নিশ্চিত নন এই কর্মকর্তা।

চট্টগ্রামের সব কটি কার্যালয়ে মোট কতগুলো ল্যাপটপ আছে—এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, কতটা আছে, এর আপডেট হিসাব নেই।

জালিয়াতিতে যুক্ত দুই চক্রের সন্ধান 

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র বলছে, তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে এনআ​ইডি জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত দুটি চক্র সম্পর্কে জানা গেছে। এর মধ্যে একটি চট্টগ্রামে ইসির পিয়ন জয়নাল আবেদীনকে ঘিরে এবং অপরটি ঢাকাকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে। ইসি–সংশ্লিষ্ট প্রায় ২০ জনকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। 

দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. শরিফ উদ্দিন গতকাল তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে যেসব নাম এসেছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে ঢাকায় অনুমতি চেয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছে।

খোয়া যাওয়া ল্যাপটপে ভুয়া এনআইডি তৈরি

ভুয়া এনআইডির বিষয়টি তদন্ত করছে দুদক, পুলিশ ও ইসি। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, চুরি হওয়ার পরপর এসব ল্যাপটপ বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে দীর্ঘদিন এগুলো ব্যবহার করে ভুয়া এনআইডি করা হয়েছে।

তদন্তের কাজে চট্টগ্রামে অবস্থান করা জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের উপসচিব ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্তত দুটি ল্যাপটপ থেকে বিভিন্ন ইনপুট দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে। অপরটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় রোহিঙ্গারা নাম-ঠিকানা পরিবর্তন করে ভোটার হচ্ছেন। এর সঙ্গে স্থানীয় লোকজন ও ইসির মাঠকর্মীরা জড়িত। মাঠপর্যায়ে ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের অনেকে অন্য অপারেটরের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে জালিয়াতির কাজ করেছেন বলেও ইসির কাছে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া ইসি কর্মকর্তাদের অনেকে নিজের পাসওয়ার্ড অফিস সহকারী ও ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের দিয়ে রেখেছেন। এসব জালিয়াতি রোধে ইসি মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের নতুন পাসওয়ার্ড দিয়েছে এ মাসের প্রথম সপ্তাহে। কাজটি আরও আগে করা হলে চুরি হওয়া ল্যাপটপ দিয়ে ভুয়া এনআইডি তৈরি করা সম্ভব হতো না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো অনেক পরে দায়িত্ব নিয়েছি। যে কারণে পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারছি না। আমরা নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছি। আশা করি দু-এক দিনের মধ্যেই বিস্তারিত জানাতে পারব।’