চার বছরেও বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির মামলার তদন্ত শেষ হয়নি

বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় করা ৫৬ মামলার তদন্ত চার বছরেও শেষ করতে পারেনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কবে এসব মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হবে, তাও জানাতে পারছেন না কেউ। তবে সংস্থাটির দাবি, তদন্ত নিখুঁতভাবে করতে সময় লেগে যাচ্ছে।

সংস্থাটির আরেকটি সূত্র বলছে, এই জালিয়াতির মামলা করার পর ব্যাংকের টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়টিও কমিশনের বিবেচনায় ছিল। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের একাধিক বক্তব্যে তা উঠে আসে। শুরুতে মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে ব্যাপক তোড়জোড় থাকলেও পরের দিকে অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়ে ওই গ্রেপ্তার অভিযান। সূত্রটির তথ্যমতে, এরই মধ্যে ১ হাজার ৩২২ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যাংকে ফেরত এসেছে। ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের কৌশলপত্র-২০১৯ নিয়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ জানিয়েছিলেন, বেসিক ব্যাংকের ৫৬টি মামলার তদন্ত শেষপর্যায়ে রয়েছে। বেসিক ব্যাংকে দেড় হাজার কোটি টাকা নগদ জমা হওয়ার তথ্যও সেদিন তিনি দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, কমিশনের মামলার কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে চুরি হওয়া কয়েক হাজার কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে।

গত ১৩ মে দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে উপস্থাপনের পর বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। সেখানেও সাংবাদিকেরা তাঁকে বেসিক ব্যাংকের অভিযোগপত্র দিতে দেরি হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করেন। সেখানে চেয়ারম্যান বলেন, ‘টাকা কোথায় গেল, তা যদি আমি কোর্টে না বলতে পারি তাহলে তো কোনো মামলাই না। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, এই টাকা কোথায় গেল, তা প্রমাণ করা।’

দুদক আইনে প্রতিটি মামলার তদন্ত সর্বোচ্চ ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা থাকলেও তদন্তের ব্যাপকতা ও জটিলতা বিবেচনায় বাড়তি সময় দেওয়ার রীতিও রয়েছে। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের ৫৬ মামলার ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের পরও অতিরিক্ত সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেছে। তার পরও আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। কবে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে, তাও জানাতে পারছেন না কেউ।

দুদকের কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের মামলাগুলো বেশ জটিল। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে জালিয়াতরা বিভিন্ন জায়গায় পাচার করেছে। টাকার প্রবাহ চিহ্নিত করার বিষয়টি বেশ কঠিন। আমাদের কর্মকর্তারা এখন সেটাই করছেন। কারা টাকা নিয়েছেন, এর বেনিফিশিয়ারি কারা, তাও বের করা হচ্ছে।’ দুদক কমিশনার বলেন, ‘এসব মামলার তদন্ত নিয়ে সবার উৎকণ্ঠাকে আমরা স্বাগত জানাই। এই মামলায় জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না, এই নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারি।’

বেসিক ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের তদন্ত প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুদকে পাঠানো হয় ২০১৩ সালে। পরে অভিযোগটি অনুসন্ধান করে ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় ১২০ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুদক। ২ হাজার ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় এসব মামলায়। বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামসহ ২৭ কর্মকর্তা, ১১ জরিপকারী ও ৮২ ঋণ গ্রহণকারী ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। পরে আরও ৫টি মামলা করে সংস্থাটি। আত্মসাৎ হওয়া সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার মধ্যে বাকি ২ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনাগুলো এখনো অনুসন্ধান পর্যায়ে।

বেসিক ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ অধিকাংশ প্রতিবেদনে আবদুল হাইয়ের সংশ্লিষ্টতার কথা উঠে আসে। খোদ অর্থমন্ত্রী বেসিক ব্যাংকে ‘হরিলুটের’ পেছনে আবদুল হাই বাচ্চু জড়িত বলে উল্লেখ করেন। জাতীয় সংসদেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়। সংসদীয় কমিটিতেও এ জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন কমিটির সদস্যরা।

অথচ ওই ঘটনায় দায়ের করা কোনো মামলাতেই বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি। অনুসন্ধানকালে তাঁকে কখনো দুদকে ডাকাই হয়নি। আদালতের একটি আদেশের পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তাঁকে প্রথমবারের মতো তলব করে দুদক। এ পর্যন্ত পাঁচবার দুদক কার্যালয়ে পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল জিজ্ঞাসাবাদ করে বাচ্চুকে।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান চার বছরেও বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির মামলাগুলোর অভিযোগপত্র না দেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অবস্থান ও পরিচয় বিবেচনায় না নিয়ে তদন্ত করার ক্ষমতা দুদককে আইনে দেওয়া হয়েছে। তারা সেটা করতে ব্যর্থ হলে তাদের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। অবস্থান ও পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে নজিরবিহীন এই কেলেঙ্কারির মূল হোতাদের আইনের কাছে সোপর্দ করার সময় এখনো তাদের কাছে আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বেসিক ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের মার্চে তা দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকায়। ওই ৪ বছর ৩ মাসে ব্যাংকটি ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়, যার প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকাই নিয়ম ভেঙে দেওয়া হয়েছে।