চার ল্যাপটপ চুরির মামলা নিষ্পত্তির কথা জানে না ইসি

নির্বাচন কমিশন
নির্বাচন কমিশন

ল্যাপটপ উদ্ধার ছাড়াই চন্দনাইশে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজে ব্যবহৃত চার ল্যাপটপ চুরির মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন (নিষ্পত্তি) দিয়ে দায় সেরেছিল পুলিশ। বাদী নির্বাচন কর্মকর্তা এবং নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কেউ সাত বছর ধরে মামলাটির কোনো খোঁজ রাখেননি। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ইসি জানে, মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।

ফলে চোর চক্র শনাক্ত না হলেও এ বিষয়ে কোনো নারাজি আবেদন করেনি ইসি। এত বছর ধরে চুরি
যাওয়া ল্যাপটপ জাতীয় তথ্য ভান্ডারের (সার্ভার) সঙ্গে যুক্ত কি না এ সম্পর্কেও স্পষ্ট কিছু বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।

তবে নির্বাচন কার্যালয়ের বাইরে অবৈধভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরির কাজে ইসির ল্যাপটপ ব্যবহৃত হওয়ার প্রমাণ ইতিমধ্যে মিলেছে। গত সোমবার গ্রেপ্তার হওয়া ইসির ডবলমুরিং থানার কর্মচারী জয়নাল আবেদীনের কাছ থেকে এমন একটি ল্যাপটপ উদ্ধারও হয়েছে। গতকাল আরও একটি ল্যাপটপ উদ্ধার হয়েছে ইসির এক অস্থায়ী ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মোস্তফা ফারুকের কাছ থেকে।

এদিকে, গ্রেপ্তার নির্বাচন কমিশনের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনসহ তিনজন রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তাঁরা প্রতিটি এনআইডি তৈরির জন্য ৩০ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিতেন। এই পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি এনআইডি তৈরি করেছেন তাঁরা।

গত ২২ আগস্ট লাকী নামের এক নারী চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে এনআইডির স্মার্ট কার্ড তুলতে গেলে কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ওই নারী রোহিঙ্গা। এই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে ডবলমুরিং থানার অফিস সহায়ক জয়নালসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় করা মামলাটি তদন্ত করছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রাম।

ল্যাপটপ চুরির কিনারা হয়নি

চারটি ল্যাপটপ ২০১২ সালের ৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের গ্রিল কেটে চুরি হয়। পরে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বাদী হয়ে থানায় চুরির মামলা করেন। চন্দনাইশ থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক রফিকুল ইসলাম সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে নয়জনকে গ্রেপ্তার করেন।

তাঁরা হলেন বোরহান উদ্দিন, নোমান শিবলী, আজিজুর রহমান, মহিউদ্দিন ফারুক, মেহেদী হাসান, আবু সিকদার, মো. ইমরান, আবু সৈয়দ ও দোস্ত মোহাম্মদ। তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় তিন মাস পর (২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি) আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন এসআই রফিক।

এতে বলা হয়, ল্যাপটপগুলো চুরির সঙ্গে কে বা কারা জড়িত শনাক্ত করা যায়নি। গ্রেপ্তার নয় আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। পুলিশের দেওয়া এই প্রতিবেদন গ্রহণ করেন আদালত। মামলাটি নিষ্পত্তি হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় চক্রটি।

চন্দনাইশ থানার ওসি কেশব চন্দ্র চক্রবর্তী মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয় বলে জানান। গতকাল আদালতের নিবন্ধন শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে।

জানতে চাইলে বাদী আশরাফুল আলম বলেন, মামলার পর তিনি চন্দনাইশ থেকে বদলি হয়ে যান। এরপর মামলা সম্পর্কে কোনো চিঠিপত্র পাননি।

শুধু বাদী নন, মামলাটি নিয়ে জেলা নির্বাচন কার্যালয় কিংবা ইসি কোনো খোঁজখবর রাখেনি এখনো পর্যন্ত। গতকাল সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের সাবেক জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এবং বর্তমানে ইসির উপসচিব খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জানামতে মামলাটি চলমান আছে।’ মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে এমন তথ্য জানালে তিনি বলেন, ‘আমি তো জানি মামলাটি এখনো বিচারাধীন আছে।’

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আইয়ুব খান প্রথম আলোকে বলেন, ইসি নারাজি দিলে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশের অন্য কোনো সংস্থাকে দায়িত্ব দিতেন।

আরেকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ

ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মোস্তফা ফারুককে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তাঁর কাছ থেকে খোয়া যাওয়া একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু এটি কোন কার্যালয়ের তা নিরূপণ করা যায়নি। তাঁকেও কোতায়ালি থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে।

মোস্তফা জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে প্রায় ১০ বছর ধরে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করে আসছেন। চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমেও তিনি চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের অধীনে কাজ করেছেন। তবে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন খান দাবি করেন, ‘মোস্তফা ২০১৬ সালে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করত। এরপর আবার কাজ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু আমি দেইনি।’

৩০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় এনআইডি

জয়নালসহ তিনজন রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে জানান, একটি এনআইডি তৈরিতে তাঁরা ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা নেন। তৈরি করতে আসা বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। আর মোস্তফা নেন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রামের পরিদর্শক রাজেস বড়ুয়া তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো যাচাই-বাছাই চলছে।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ইসির আইটি বিশেষজ্ঞ মো. শাহাবুদ্দিন জানান, চক্রটির প্রায় তিন হাজার এনআইডি তৈরির তথ্য পাওয়া গেছে।

ল্যাপটপের তালিকা তৈরি হচ্ছে

চট্টগ্রাম থেকে কতটি ল্যাপটপ খোয়া গেছে তা যাচাই–বাছাই করে দেখছে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা কার্যালয়। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন খান বলেন, ‘আমাদের এখন ৬৩টি ল্যাপটপ সচল রয়েছে। ২৩টি অকেজো রয়েছে। কোনো ল্যাপটপ খোয়া গেছে কি না তা জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে ইসি। তিন দিনের মধ্যে ঢাকায় প্রতিবেদন দিতে হবে।’