ছাত্রদলের নেতৃত্ব নির্বাচনে 'অঞ্চলপ্রীতি'

নানা চাপ ও বাধা-বিপত্তির পরও ভোটের মাধ্যমে ছাত্রদলের সম্মেলন সুষ্ঠুভাবে করতে পেরে উৎফুল্ল বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। প্রায় ২৭ বছর পর গত বুধবার রাতে কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে ছাত্রদলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন ফজলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়েছেন ইকবাল হোসেন।

বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, নানা বিবেচনায় এবার ছাত্রদলের নির্বাচন এবং এর ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই প্রথম ছাত্রদলের কয়েকজন নেতার ‘বলয়’ ভেঙে দিয়েছে এই নির্বাচন। তবে সংগঠনের দীর্ঘদিনের ‘মনোনীত নেতৃত্বের’ সংস্কৃতি থামানো গেলেও এবার জেগে উঠেছে অঞ্চলপ্রীতি। 

সভাপতি পদে জয়ী ফজলুর রহমান পেয়েছেন ১৮৬ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কাজী রওনাকুল ইসলাম পেয়েছেন ১৭৮ ভোট। ফজলুরের বাড়ি বগুড়ায়। তাঁর পক্ষে বিএনপির উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বশীল নেতারা নানাভাবে তৎপর ছিলেন বলে দলে প্রচার আছে। ফজলুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র। তিনি ছাত্রদলের গত কমিটিতে গণশিক্ষাবিষয়ক সহসম্পাদক ছিলেন।

ফজলুরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রওনাকুলের জন্য সক্রিয় ছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের নেতারা। বিশেষ করে রওনাকুলের জন্য ছাত্রদলের সাবেক এক সভাপতির তৎপরতার কথা সংগঠনে এখন অন্যতম আলোচিত বিষয়। নেতা–কর্মীরা বলছেন, সম্মেলন নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার একটি পর্যায় পর্যন্ত ফজলুর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিনের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু সালাহউদ্দিন একপর্যায়ে রওনাকুলের জন্য সক্রিয় হলে ফজলুরও অবস্থান পাল্টে বিএনপির উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সহায়তা নেন। ফজলুরের কাছে মাত্র ৮ ভোটে হারেন আলোচিত প্রার্থী রওনাকুল। 

ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয়, ভোটাররা সংগঠনে ত্যাগ ও শ্রমের মূল্যায়ন করে আমাদের নির্বাচিত করেছেন। এখানে কোনো অঞ্চলপ্রীতি ছিল বলে মনে করি না।’ 

অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদে জয়ী ইকবাল হোসেন পেয়েছেন ১৩৯ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাকিরুল ইসলাম পেয়েছেন ৭৪ ভোট। ইকবালের বাড়ি নরসিংদীতে। তিনি ছাত্রদলের বিগত কমিটির সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানের এলাকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র ইকবাল ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ভোটের আগে কাউন্সিলরদের মধ্যে তাঁর নাম আলোচনায় ছিল এক-দুজনের পর। 

নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর সংগঠনের ভেতরে বলাবলি হচ্ছে, ইকবালের জয়ে আকরামুল হাসানের ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা বলছেন, ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসান বেশির ভাগ সময় জেলে ছিলেন। তখন অনেক জেলা ও সাংগঠনিক ইউনিটে ছাত্রদলের কমিটি হয়। ওই সব ইউনিটের কাউন্সিলরদের মধ্যে আকরামুল হাসানের একটা প্রভাব ছিল, যা ইকবালের পক্ষে গেছে বলে নেতা-কর্মীরা মনে করছেন। ছাত্রদলের পরপর তিনটি কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক হওয়া তিনজনের বাড়ি নরসিংদীর। এটি ইলিয়াস আলী ‘বলয়’ হিসেবে পরিচিত। 

১৯৯২ সালের পর ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনে এই প্রথম সরাসরি ভোট হলো। ওই কাউন্সিলে রুহুল কবির রিজভী সভাপতি এবং এম ইলিয়াস আলী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিও কয়েক মাসের মাথায় নানা বিতর্কের মুখে সেই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়।

শঙ্কার মধ্যে রাতে ভোট

বিএনপির নেতারা বলছেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের সম্মেলন অনুষ্ঠান কিছুটা অনিশ্চয়তা ও দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছিল। এর মধ্যেই অনেকটা গোপনীয়তা রক্ষা করে দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচন করা হয়। শাহজাহানপুরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বাড়িতে ভোট হয়। বুধবার রাত ৯টা থেকে রাত পৌনে ১টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলে। ভোরে ফল ঘোষণা করেন মির্জা আব্বাস। 

শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারাটাকে বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন নেতারা। বিশেষ করে ছাত্রদলের ১১৭টি সাংগঠনিক শাখার ৫৩৪ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৪৮১ জনের ভোট দেওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন তাঁরা। ১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের ষষ্ঠ সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু এক দিন আগে ছাত্রদলের এক নেতার আবেদনে আদালতের এক নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়। এর জন্য বিএনপির নেতারা সরকারকে দায়ী করেন। 

নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচনটা করা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। আদালতের নিষেধাজ্ঞা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে ভীতি ছড়ানো হয়েছিল। নির্বাচনের আগে ৯ জন কাউন্সিলরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ অবস্থায় কাউন্সিলররা নিজেরা দায়িত্ব নিয়েছেন, আমরা তাঁদের সহযোগিতা দিয়েছি নির্বাচনে।’