মেশিন-কুকার দেওয়ার নামে ২০ লাখ টাকা নিয়ে উধাও

প্রতারণার শিকার কয়েকজন নারী। হাজী আসমত আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।  প্রথম আলো
প্রতারণার শিকার কয়েকজন নারী। হাজী আসমত আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। প্রথম আলো

বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটা। ভৈরব পৌর শহরের চণ্ডীবের দক্ষিণপাড়ায় অবস্থিত হাজী আসমত আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে দুই শতাধিক নারী দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা এস কে ব্লু-বার্ড মিশন টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার নামের একটি সেলাই ও রান্না প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষকেরা আসবেন বলে। এসে তাঁরা সদস্যদের মধ্যে সেলাই মেশিন ও প্রেশার কুকার বিতরণ করবেন। কারণ, ওই দিন সেলাই মেশিন ও প্রেশার কুকার দেবেন বলে প্রশিক্ষকেরা আগেই জনপ্রতি দুই হাজার টাকা করে নিয়েছেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল শেষে সন্ধ্যা—তখনো কেউ এসে পৌঁছাননি। আবার সংশ্লিষ্ট সবার মুঠোফোনও বন্ধ। পরে সবাই বুঝতে পারেন, তাঁরা প্রেশার কুকার ও সেলাই মেশিনের ফাঁদে পড়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু হাজী আসমত আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রই নয়, পৌর শহরের আরও তিনটি কেন্দ্রের সহস্রাধিক নারী একই প্রতিষ্ঠানের হাতে প্রতারিত হয়েছেন। এভাবে তাঁরা প্রায় ২০ লাখ টাকা খুইয়েছেন।

শ্যামলী সূত্রধরের অভাবের সংসার। সেলাইয়ের কাজ শেখা গেলে অভাব গুছবে—এমন ভাবনা থেকে অনেকের দেখাদেখি তিনিও হাজী আসমত কেন্দ্রে নাম লিখিয়েছিলেন। শ্যামলী বলেন, দুই হাজার টাকায় আট হাজার টাকার মাল পাবেন ভেবে ঋণ করে টাকা এনে দিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে সেলাই শিখে আবার তাদের দেওয়া মেশিন দিয়ে কাজ করে ঋণ পরিশোধ করবেন—এমনই ছিল ভাবনা। কিন্তু এখন দেখছেন সব ভাঁওতাবাজি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এস কে ব্লু-বার্ড মিশন টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের প্রধান কার্যালয় খুলনায়। এক মাস আগে এসে কাজ শুরু করে তারা। ক্লাস শুরু হয় দুই সপ্তাহ আগে।

ভুক্তভোগী নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কথা ছিল এক মাসের মধ্যে সেলাই ও রান্না দুই-ই শেখাবে। এ জন্য শুধু ভর্তি ফি বাবদ ১০০ টাকা লাগবে। ভর্তি হওয়ার পর জানানো হয়, সেলাই শেখানোর জন্য সুতাসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণ বাবদ আরও ২০০ টাকা দিতে হবে। সবাই টাকা দেন। পাঁচ দিন ক্লাস হওয়ার পর দেওয়া হয় লোভনীয় অফার। বলা হয়, একটি বিশেষ অনুদানে পাওয়া তাদের কাছে প্রচুর উন্নত মানের সেলাই মেশিন ও প্রেশার কুকার রয়েছে। সেলাই মেশিনটির বর্তমান বাজারমূল্য ছয় হাজার টাকা আর প্রেশার কুকারের দাম দুই হাজার টাকা। মোট আট হাজার টাকার পণ্য তাদের পক্ষে মাত্র দুই হাজার টাকায় দেওয়া সম্ভব। তখন সবাই টাকা দিতে প্রতিযোগিতা শুরু করেন। শুধু হাজী আসমত আলী কেন্দ্রেরই ৪০০ সদস্যের মধ্যে প্রায় ৩০০ নারী সেলাই মেশিন ও প্রেশার কুকার পেতে টাকা পরিশোধ করেন।

প্রতারণার শিকার নারীরা জানান, প্রশিক্ষকেরা কখনো নিজেদের নাম–পরিচয় বলতে চাইতেন না। এমনকি ছবি তুলতে গেলে সেই সুযোগও দিতেন না। একজনের নাম জানতে পেরেছেন। তাঁর নাম এম ডি অ্যানি। একই সময়ের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটি ভৈরবের হাজী জহির উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়, সান ফ্লাওয়ার কিন্ডারগার্টেন, ঘোড়াকান্দা ও কালিপুরে আরও চারটি কেন্দ্র খুলে বসে। পাঁচটি কেন্দ্রে প্রশিক্ষণার্থী অন্তত দেড় হাজার। সব কেন্দ্র থেকে একইভাবে এবং একই লোভ দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।

হাজী আসমত আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রশিক্ষণার্থী নাহিদা আক্তার বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে হাজী আসমতের নাম শুনে আমাদের আস্থা তৈরি হয়। প্রশিক্ষকেরা দূরের হলেও কেন্দ্রটি পরিচিত হওয়ায় বিশ্বাস থেকে টাকা দিয়েছি।’ ইসরাত জাহান বলেন, অবশ্যই কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল কেন্দ্র ব্যবহারের আগে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া।

হাজী আসমত আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক কামরুজ্জামান খান বলেন, প্রতিষ্ঠানের লোক এসে তাঁদের কাছে বিনয়ের সঙ্গে আবেদন করেছেন। তাঁরা ভেবেছেন কাছাকাছি স্থানে এসে অনেকে সেলাই ও রান্না শেখার সুযোগ পাবেন। বিনিময়ে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের গরিব ৭০ জন শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ দেবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সবটাই প্রতারণা।

হাজী জহির উদ্দিন বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রশিক্ষণার্থীদের দাবি, এ ঘটনার দায় কোনোভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। এ বিষয়ে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক অহিদুজ্জামান বলেন, ‘এক মাসে চার হাজার টাকা পাব, এর বিনিময়ে আমরা শুধু কক্ষ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছি।’

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, আইনের আশ্রয় নিতে তাঁদের অনেকে গত বৃহস্পতিবার থানায় যান এবং লিখিত অভিযোগ দিয়ে আসেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুবনা ফারজানা বলেন, যেসব জায়গায় কেন্দ্র ছিল, সেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানতে চাওয়া হবে, তারা কেন নাম–পরিচয় না জেনে প্রতিষ্ঠান ব্যবহারের সুযোগ দিল।