ছুটে চলেছেন 'লাল মানব'

বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন আনোয়ার হোসেন। সম্প্রতি বগুড়া সদর উপজেলার সাত শিমুলিয়া গ্রামে।  সোয়েল রানা
বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন আনোয়ার হোসেন। সম্প্রতি বগুড়া সদর উপজেলার সাত শিমুলিয়া গ্রামে। সোয়েল রানা

পরনের শার্ট ও পায়জামা, মাথার টুপি, চোখের চশমা, পায়ের জুতা—সবকিছুই তাঁর লাল রঙের। এ ব্যক্তির নাম আনোয়ার হোসেন। আর এই লাল হচ্ছে বাল্যবিবাহের বিপৎসংকেত। এভাবেই তিনি বাইসেকেলে চেপে হাতমাইকে বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারণা চালান। 

আনোয়ার হোসেনের বাইসাইকেলও লাল রঙের। এমনকি বাঁশি ও হাতমাইকেও লালের ছোঁয়া।  বাঁশিতে ফুঁ দিতে দিতে সাইকেলে প্যাডেল মেরে পৌঁছে যান গ্রাম থেকে শহরে। প্রতিদিন নতুন ভোর, নতুন রাস্তা, নতুন শহর, নতুন মানুষের মুখ। স্কুল-কলেজে ছাত্রীদের কাছেও পৌঁছ যান। গায়ের পোশাক, টুপি ও সাইকেলে বাল্যবিবাহবিরোধী নানা বার্তা লেখা। শার্টের পেছনে লেখা, ‘হতে চাই না বিয়ের পাত্রী, হতে চাই স্কুলের ছাত্রী’, ‘সকল শিশু বিদ্যালয়ে, হবে না বিয়ে বাল্যকালে’। লাল শার্টের সামনে লেখা, ‘বাল্যবিয়েকে না বলুন, বাল্যবিয়েকে লাল কার্ড দিন’।  

৫৩ বছর বয়সী আনোয়ার হোসেন পেশায় কাঠমিস্ত্রি। শত বাধা তুচ্ছ করে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যে লাল রঙের বাইসাইকেলে ৬৪ জেলায় বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন। প্রায় ২০৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষাথীদের মধ্যে বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারপত্র বিতরণ করেছেন, হাতমাইকে প্রচারণা ছাড়াও বাল্যবিবাহে রাজি না হতে ছাত্রীদের শপথ করিয়েছেন। ছাত্রীরা হাততালি দিয়ে বাল্যবিবাহকে ‘না’ বলেছে। দেশজুড়ে পরিচিতি তাঁর ‘লাল মানব’ নামে। 

আনোয়ার হোসেনের বাড়ি বগুড়া সদর উপজেলার বারপুর গ্রামের উত্তরপাড়ায়। কোনো জায়গায় বাল্যবিবাহ হচ্ছে, সে খবর শুনলে তিনি নিজে তা ঠেকানোর চেষ্টা করেন। প্রয়োজনে প্রশাসনের সহায়তা নেন। তাঁর বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারণা নিয়ে ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর প্রথম আলোয় সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। এরপর জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ তাঁকে নিয়ে বাল্যবিবাহবিরোধী তথ্যচিত্র নির্মাণ করে।

সম্প্রতি বগুড়া সদর উপজেলার সাতশিমুলিয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারণা চালাতে এলে আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারণায় সবকিছু লাল কেন? আনোয়ার হোসেনের উত্তর, ‌‘বাল্যবিবাহ মানেই বিপজ্জনক, দেশের জন্য অভিশাপ। লাল বিপদের সিগন্যাল (সংকেত)। বাল্যবিবাহও সমাজের জন্য বিপদ। বাল্যবিবাহের ভয়াবহতা বোঝানোর জন্যই সবকিছু লাল।’ 

আনোয়ার হোসেনের শৈশব কেটেছে অভাব–অনটনে। পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষা দেওয়ার পর টাকার অভাবে বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি। ‘হোটেল বয়ে’র কাজ করতে হয়েছে বগুড়ার শহরে। এরপর জীবিকার খোঁজে চট্টগ্রামে যান। সেখানকার একটি আসবাবের দোকানে কাজ নেন। বিয়ে করে সেখানেই থিতু হন। চট্টগ্রামে থাকাকালে স্কুলপড়ুয়া দুই কিশোরী ভাগনির বাল্যবিবাহ হয়। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় দুজনের সংসারই ভেঙে যায়। দুজনের স্বামী বিদেশ গিয়ে আর ফেরেননি। বাবাহারা দুই বোন কাজ নেয় ঢাকায় পোশাক কারখানায়।

আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কাঠমিস্ত্রি বলে কিছুই করতে পারিনি। ভাগনিদের মতো আর কোনো মেয়ে যেন অল্প বয়সে বাল্যবিবাহের শিকার না হয়, এ জন্য ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে দোকান বেইচা সাইকেল কিনে বাল্যবিবাহ রুখতে পথে নামচি। হামাকেরে সন্তান যাতে বাল্যবিবাহের বলি না হয়, এ জন্য এ বিষয়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে ৬৪ জেলায় ২০৫টি বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রচারণা চালাচি, লিফলেট বিতরণ করচি। হামার স্বপ্ন, এ দেশে একটি মেয়েও বাল্যবিবাহের শিকার হবি না। এ দেশ হবি শতভাগ বাল্যবিবাহমুক্ত।’

আনোয়ার হোসেন বলেন, বাল্যবিবাহের শিকার অল্প বয়সী দুই ভাগনির করুণ পরিণতিতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। এরপর খবরের কাগজে বাল্যবিবাহের সংবাদ দেখলেই খারাপ লাগত। বাল্যবিবাহ বন্ধে কিছু একটা করার কথা ভাবতাম। কিন্ত একজন কাঠমিস্ত্রির পক্ষে কীই–বা করা সম্ভব, এটা ভেবে দমে গেলাম। এভাবে দুই যুগ কেটে গেল। লাল সাইকেলে ঘুরে ঘুরে বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারণার ভাবনা একদিন মাথায় এল। তত দিনে কাঠের আসবাবের ছোটখাটো একটি দোকান দাঁড় করিয়েছিলাম। এই দোকান বিক্রি করে পুরোনো একটি সাইকেল কিনলাম। তাতে লাল রং করলাম। কিছু প্রচারপত্রও ছাপা হলো। এরপর লাল সাইকেলে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযাত্রা শুরু হলো। প্রথম দফায় কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রাম শহর ঘুরে বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারপত্র বিলি করলাম। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে লাল সাইকেলে করে ৬৪ জেলার উদ্দেশে বের হলাম। প্রায় তিন মাসে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারণা শেষ করলাম। ৬৪টি জেলা প্রশাসক কিংবা তাঁদের প্রতিনিধি, পুলিশ সুপার ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে ডায়েরিতে বাল্যবিবাহবিরোধী মন্তব্য লিখে নিলাম। 

লাল সাইকেলে প্রচারণার বিষয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষ। স্ত্রী-সন্তানেরও মুখেও ভাত তুলে দিতে হয়। তাই বছরের আট মাস অন্যের দোকানে কাঠমিস্ত্রির কাজ করি। শীতের চার মাস দেশ ঘুরে লাল সাইকেলে বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারণা চালাই। এ ছাড়া বাল্যবিবাহের খবর পেলে, তা ঠেকানোর জন্য ছুটে গেছি। অভিভাবকদের বুঝিয়ে সম্ভব না হলে প্রশাসনের সহযোগিতায় বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছি। এ পর্যন্ত ২৫ থেকে ৩০টি মেয়েকে বাল্যবিবাহের কবল থেকে রক্ষা করেছি। হাতমাইকে বাল্যবিবাহের কুফল তুলে ধরেছি। পথে–ঘাটে, শহরে–গঞ্জে বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারপত্র বিলি করেছি।’

পরিবার বা পরিচিতজনেরা তাঁর এ কাজকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? আনোয়ার হোসেন বলেন, এভাবে লাল সাইকেল, লাল পোশাকসহ সবকিছু লাল নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ানোয় শুরুতে সবাই তাঁকে ‘পাগল’ ডাকা শুরু করে দিয়েছিল। স্ত্রীও এটাকে পাগলামি বলতেন। ২০১৫ সালে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। সবাই এ কাজের জন্য উৎসাহ দিতে থাকেন।

আনোয়ার হোসেনের এই অনন্য প্রচারণাকে সাধুবাদ জানিয়ে তাঁর ডায়েরিতে মন্তব্য করেছেন অনেকেই। তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার তাঁকে নিয়ে মন্তব্য লিখেছেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সাইকেলে দেশ ঘুরে আনোয়ার হোসেন যে প্রচারণা চালাচ্ছেন, তাতে অন্যরাও সচেতন হবেন। 

জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সভাপতি সাংসদ শওকত আলী লিখেছেন, ‘শুভ উদ্যোগের মহানায়ক আনোয়ার হোসেনের কল্যাণ হোক।’ 

র‌্যাব-১৩–এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক মন্তব্য লিখেছেন, বাল্যবিবাহ রুখে দিতে একজন হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের এই অনবদ্য উদ্যোগ অনন্য দৃষ্টান্ত ও সবার জন্য অনুপ্রেরণা জোগাবে। আনোয়ার হোসেনের মতো স্বপ্নের এ রকম ফেরিওয়ালার হাত ধরেই ‘বাল্যবিবাহমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়া সম্ভব হবে।