গাভি পালনের ঋণ আ.লীগ নেতাদের স্ত্রী, কন্যার নামে

প্রকল্পের নাম ‘উন্নত জাতের গাভি পালনের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন’। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সহজ শর্তে ১ লাখ ২০ হাজার করে টাকা ঋণ দিচ্ছে সরকার। এই তালিকায় দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার অমরপুর ও আবদুলপুর ইউনিয়নের ২০০ জনের নাম রয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের শর্ত অনুযায়ী, তাঁদের বেশির ভাগই এই ঋণ পাওয়ার উপযুক্ত নন।

ওই ঋণ বরাদ্দ ও তালিকাভুক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান খান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, তালিকা করতে স্থানীয় আওয়ামী, যুবলীগসহ বিভিন্নজনের নাম    তাঁদের হাতে এসেছিল। সেভাবেই উপকারভোগী নির্বাচন করতে হয়েছে। প্রকল্পের শর্ত অনুযায়ী কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে গিয়ে উপকারভোগী নির্বাচন করতে পারেননি।

ঋণের জন্য তালিকাভুক্ত ২০০ জনের মধ্যে ১১২ জনের তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। তাতে দেখা যায়, ১১২ জনের মধ্যে ঋণ পাওয়ার শর্ত পূরণ হয়েছে ৪০ জনের। ৭২ জনেরই শর্ত পূরণ হয়নি। এই ৭২ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের পদ-পদবিধারী ব্যক্তিদের স্বজন ৩৩ জন।

ঋণ পাওয়া ব্যক্তিদের একজন আবদুলপুরের থানাপাড়া এলাকার মনিরা ইসলাম চৌধুরী। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক মো. ফয়জুল ইসলাম চৌধুরীর স্ত্রী। ফয়জুলের সারের ব্যবসা রয়েছে। ১০টি গরু নিয়ে বাড়িতে তাঁদের খামারও রয়েছে। ঋণ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আরও রয়েছেন ফয়জুলের মামাতো ভাই উপজেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদের স্ত্রী সুমি আক্তার, হারুনের ভাই ফারুক হোসেনের স্ত্রী শিউলি আরা খাতুন ও চাচা উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মাহতাব উদ্দিন সরকারের স্ত্রী শাহনাজ পারভীন। জানতে চাইলে ফয়জুল ও হারুন বলেন, ‘আমরা দল করি। এই সুযোগ তো আমাদেরই প্রাপ্য।’

তবে প্রকল্পের প্রস্তাবে শর্ত রয়েছে, যাঁদের লালনপালনের জায়গা আছে কিন্তু অর্থাভাবে গরু কিনতে পারছেন না, সুবিধাবঞ্চিত এমন নারীরা এ ঋণ পাবেন।

উপজেলা সমবায় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের জুনে অধিকতর দারিদ্র্যসীমার মধ্যে অবস্থানকারী ৫০টি উপজেলায় ওই প্রকল্প চালু করা হয়। এর মধ্যে অমরপুর ও আবদুলপুর ইউনিয়নের ২০০ জনের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। এ নারীরা দুটি করে গাভি কিনে পালনের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার করে টাকা পাবেন। এ টাকা চার ধাপে দেওয়া হবে। ঋণ পাওয়ার এক বছর পর দিনে উপকারভোগীরা ২০০ টাকা করে মাসিক কিস্তির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করবেন। সার্ভিস চার্জ হিসেবে ২ হাজার ৪০০ টাকা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ওই দুই ইউনিয়নে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে তালিকাভুক্ত ১০০ জন ঋণ পেয়েছেন। তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের উপকারভোগীদের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

কয়েক দিন ধরে ৬৬ জন উপকারভোগীর বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, তাঁদের মধ্যে ৪১ জনই ঋণ পাওয়ার শর্ত পূরণ করেন না। এর মধ্যে অন্তত তিনজনের বাড়িতে গরুর খামার রয়েছে। চারজন গরুর ব্যবসা করেন। চারজনের রয়েছে ছাদ করা একতলা বাড়ি। তিনজনের মালিকানাধীন বিপণিবিতান রয়েছে।

ঋণ পাওয়ার তালিকায় রয়েছেন উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পুত্রবধূ, কলেজের প্রভাষক, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের স্ত্রীসহ অনেকে। রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আজিমউদ্দিনের স্ত্রী মোছা. মঞ্জুয়ারা খাতুন ও তাঁর ভাই আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী ফেরদৌসী বেগমও। জানতে চাইলে আজিমউদ্দিন বলেন, ‘আমরা কি কোটিপতি নাকি?’

তালিকায় আরও রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আইয়ুবুর রহমান শাহর দুই পুত্রবধূ ও এক মেয়ে। তাঁরা হলেন মো. আশরাফুলের স্ত্রী মোছা. খাদিজা বেগম, মো. খায়রুল আলমের স্ত্রী লিলি আক্তার ও মো. সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী মোছা. আছমা খাতুন। আশরাফুলের অন্তত ৫০টি গরু নিয়ে খামার রয়েছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইয়ুবুর রহমান শাহ বলেন, ‘উপজেলা থেকে তালিকা করে আমরা এমপির (সাংসদ) কাছে পাঠিয়েছিলাম। তিনি তালিকা চূড়ান্ত করেছেন। মূলত এমপির ডিও লেটারের (চাহিদাপত্র) মাধ্যমে উপকারভোগীরা ঋণ পেয়েছেন।’ নিজের দুই পুত্রবধূ ও মেয়ের ঋণ পাওয়ার বিষয়ে আইয়ুবুর বলেন, ‘আমার ছেলেমেয়ে যদি ঋণের হকদার হন, অবশ্যই তাঁরা ঋণ পাবেন।’

চিরিরবন্দর দিনাজপুর-৪ আসনে পড়েছে। এ আসনের সাংসদ আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সই করা ডিও লেটারে দেখা যায়, তিনি ওই প্রকল্পের ঋণ দিতে ৫০ জনের নাম তালিকায় দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথম আলো ২৭ জনের তথ্য সংগ্রহ করেছে। তাতে দেখা যায়, ২০ জনই ঋণ পাওয়ার শর্ত পূরণ করেন না।

ওই ২০ জনের একজন উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সিদ্দিকা জামান। তিনি বলেন, ‘আমরা মধ্যবিত্ত, আমরাই এ ঋণ পাওয়ার যোগ্য। আমাদের চেয়ে ভ্যান-রিকশাওয়ালাদের টাকা অনেক বেশি। আমার মতো আরও অনেকে এ ঋণ পেয়েছেন। তাঁদের জিজ্ঞেস করেন।’

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গত মঙ্গলবার সাংসদ আবুল হাসান মাহমুদ আলীর মুঠোফোন নম্বরে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক সমবায় অধিদপ্তরের অতিরিক্ত নিবন্ধক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, দেশের ৫০টি উপজেলায় শুধু সুবিধাবঞ্চিত নারীদের এ ঋণ দেওয়া হচ্ছে। কোথাও ঋণ দেওয়ার শর্ত মানা হয়নি—এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে সেই তালিকা বাতিল করা হবে।