শিক্ষক শ্রীকান্ত চন্দ্রের ছাদবাগান

ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ছাদবাগানে গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত শ্রীকান্ত চন্দ্র। ১৯ সেপ্টেম্বর তোলা।
ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ছাদবাগানে গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত শ্রীকান্ত চন্দ্র। ১৯ সেপ্টেম্বর তোলা।

কিছুদিন ধরে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে আবিদ হাসান। বাড়ির বাগানটাকে আরও বড় করার পাশাপাশি পড়াশোনায়ও মনোযোগ বাড়ানোর কথা ভাবছে সে। স্বপ্নের পেছনের যুক্তিটাও খুঁজে পেয়েছে আবিদ। একজন শিক্ষক হাজারো শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রকৃতিপ্রেম জাগিয়ে তুলতে পারেন, যেমনটা করছেন তার শিক্ষক শ্রীকান্ত চন্দ্র।

আবিদের মতো নাফি, মাহবুব, রিয়ন, শান্ত, অভিজিৎরাও স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লব ঘটানোর। তারা সবাই নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। বিদ্যালয়ের ছাদবাগানকে কেন্দ্র করে গণিতের শিক্ষক শ্রীকান্ত চন্দ্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবুজ পৃথিবীর স্বপ্ন বুনেছেন। বিদ্যালয় ভবনের ৩টি ছাদে প্রায় ৯ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। ৮২ প্রজাতির ২ হাজারের বেশি গাছ বিদ্যালয়ের বাগানে। 

ছাদবাগান দেখতে দেখতে কথা হয় শ্রীকান্ত চন্দ্রের সঙ্গে। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের দক্ষিণের তিনটি ভবনের ছাদজুড়ে বাগান। সিঁড়ি বেয়ে তিনতলার ছাদে পৌঁছাতেই কুঞ্জলতার তৈরি ফটক পেরিয়ে চোখ চলে যায় পাথরের ঢালাই দেওয়া পুরোনো ছাদে। পূর্ব–পশ্চিমে লম্বা সারিতে শত শত রঙিন টব। টকটকে লাল রক্তজবা, হলুদ অলকানন্দা আর গাঢ় নীল অপরাজিতা যেন আগত ব্যক্তিদের শুভেচ্ছা জানাতে কার্নিশে ঝুলে আছে। ফটক থেকে কিছুটা দূরে কয়েকটি তুলসী গাছ। গাছগুলোকে আগাছামুক্ত করতে করতে বলতে থাকেন শ্রীকান্ত চন্দ্র, ‘গাছ বেশি কিছু চায় না। একটু জল আর একটুকরো মাটি পেলেই খুশি। বিনিময়ে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয় পৃথিবীকে। অথচ ওদের প্রতি কী নির্মম আমরা! ইট-পাথরে শহর ঢেকে দিচ্ছি। পলিথিনে ছেয়ে ফেলছি নদী-নালা, মাঠ-ঘাট।’ শ্রীকান্ত চন্দ্রের কণ্ঠে আক্ষেপ ঝরে পড়ে।

ততক্ষণে বাগানে ছুটে আসে আবিদ, নাফি ও মাহবুব। অভ্যাসমতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গাছ দেখতে থাকে। প্রতিটি গাছের গায়ে বাংলা ও ইংরেজি অক্ষরে পরিচিতি ঝোলানো। বাগানবিলাসে জড়িয়ে থাকা কিছু স্বর্ণলতা ছাড়াতে ছাড়াতে শ্রীকান্ত চন্দ্র জানান, শিক্ষার্থীরা যেন সহজেই গাছের প্রচলিত ও বৈজ্ঞানিক নামগুলো জানতে পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। পরিচয় হয় বাগান দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিদ্যালয়ের মালি মৃত্যুঞ্জয় বৈরাগীর সঙ্গে। ‘শ্রীকান্ত স্যার না থাকলে এই বাগান হইত না,’ মৃত্যুঞ্জয়ের এমন কথায় দ্বিমত করেন শ্রীকান্ত চন্দ্র। জানান, কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য আবদুস সালাম, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কমলকান্তি সাহাসহ বেশ কয়েকজন সহকর্মীর সমন্বিত অবদান এই বাগান। বাগানের শুরুর দিকের গল্প শোনান শ্রীকান্ত চন্দ্র। শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হওয়ার পর বিদ্যালয়ের আশপাশের খোলা জায়গায় গাছ রোপণ করতেন তিনি। এক শিক্ষার্থী তাঁর কাছে ধানগাছ কেমন, জানতে চায়। শহরের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কৃষি ও গাছের পরিচয় ঘটানোর উপায় খুঁজতে থাকেন। এরই মধ্যে ২০১০ সালের শেষে বাগান করার সিদ্ধান্ত নেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। এতেই যেন হাতে চাঁদ পেয়ে যান। আবদুস সালামের নিয়ে আসা একটি আমগাছের মাধ্যমে শুরু করেন স্বপ্নের বাগান। 

কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য আবদুস সালাম জানান, বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হোসেনের উৎসাহে বাগান করার উদ্যোগ নেয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেই উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখে শ্রীকান্ত চন্দ্রের মাধ্যমে।

শহরের বিদ্যালয়গুলোতে বাধ্যতামূলক বাগান তৈরির প্রকল্প নেওয়া উচিত বলে মনে করেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কমল কান্তি সাহা। বলেন, ‘সারা বিশ্ব পরিবেশ বাঁচানোর স্লোগান দিচ্ছে। সে স্লোগান কার্যকর হতে পারে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে। আমরা কৃষিবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানানোর জন্য শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বাগানে নিয়ে যাই।’