মহাস্থানগড়ের 'কটকটি'

মহাস্থানগড়ের প্রসিদ্ধ কটকটি।  ছবি: প্রথম আলো
মহাস্থানগড়ের প্রসিদ্ধ কটকটি। ছবি: প্রথম আলো

চারকোনা বিস্কুট আকৃতির শুকনো মিষ্টান্নজাতীয় গুড়মাখা খাবার। স্বাদে অনন্য এই খাবারের নাম কটকটি। বাংলার প্রাচীন রাজধানী পুণ্ড্রবর্ধন বা মহাস্থানগড় ঘুরতে এসে এই কটকটির স্বাদ নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন দেশি-বিদেশি পর্যটক ও দর্শনার্থীরা। বগুড়ার দইয়ের মতোই পর্যটকদের মাধ্যমে এ খাবারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও। প্রায় দেড় শ বছর ধরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে মহাস্থানগড়ের এই কটকটি। 

মহাস্থানগড় ঘিরে গড়ে উঠেছে কটকটির বিশাল বাজার। এর মধ্যে গড়ের নিচে এবং বাসস্ট্যান্ডে প্রায় ২৫টি বড় দোকানে প্রতিদিন হরেক স্বাদের কটকটির বিশাল পসরা নিয়ে বসেন দোকানিরা। শুক্রবার দর্শনার্থীর ভিড়ের কারণে মহাস্থানগড়ের ওপরে ও নিচে কটকটির দোকান বসে ১০০টি। পর্যটন মৌসুমে এসব দোকানে গড়ে প্রতিদিন ১৫০ মণ কটকটি বিক্রি হয়। বছরজুড়ে প্রতিদিন বিক্রি হয় গড়ে ১০০ মণ। স্বাদ ও মানভেদে প্রতি কেজি কটকটির দাম গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। প্রতি মণ কটকটির দাম গড়ে চার হাজার টাকা। মহাস্থানগড়ে প্রতিদিন চার লাখ টাকার কটকটি বেচাবিক্রি হয়। 

প্রতিবছর বৈশাখের শেষ বৃহস্পতিবার মহাস্থানগড়ে দিনব্যাপী মেলা বসে। এ মেলায় কটকটির দোকান সাজিয়ে বসেন শতাধিক দোকানি। 

 দোকানিরা জানালেন, আগের দিনে কটকটি বেশ শক্ত ছিল। এখন কটকটি তৈরির পদ্ধতিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় এবং খামিরে ডালডার ব্যবহারের কারণে কটকটি আগের চেয়ে অনেকটাই নরম। খেতে গিয়েও এখন আগের মতো তেমন কটকট শব্দ হয় না।

মহাস্থানগড়ে কটকটির সবচেয়ে পুরোনো দোকান লাল মিয়া কটকটি ঘর। এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ লাল মিয়া প্রামাণিকের বয়স এখন ৮৩ বছর। মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে মহাস্থানগড়ে কটকটি ব্যবসায় আসেন তিনি। শুরুতে গড় এলাকায় কটকটি ফেরি করে বিক্রি করতেন। এখন গড়ের নিচেই বিশাল শোরুমে কটকটি সাজিয়ে বসেন।

প্রবীণ এই দোকানি কটকটির ইতিহাস জানাতে গিয়ে বলেন, দাদা জোহর মাহমুদ এবং বাবা মোহাম্মদ আলী প্রামাণিক গড়ে ১০০ বছর কটকটির ব্যবসা করেছেন। প্রায় ৭০ বছর ধরে তিনি নিজে এ ব্যবসার সঙ্গে রয়েছেন। সেই হিসাবে মহাস্থানগড়ের কটকটির ইতিহাস কমপক্ষে ১৭০ বছরের পুরোনো।

মহাস্থানগড়কে ঘিরে কটকটির প্রায় ১০০টি দোকান বসেছে। গড়ের নিচে বগুড়া-শিবগঞ্জ সড়কের মাজার রোডের দুপাশে আলাদা দোকানে বড় বড় গামলা ও ড্রামের ট্রেতে কটকটির বিশাল পসরা সাজিয়ে বসেছেন বেশ কিছু দোকানি। বড় দোকানগুলোর মধ্যে রয়েছে লাল মিয়া কটকটি ঘর, নাসির কটকটি প্যালেস, হামু মামা কটকটি প্যালেস, সুলতান কটকটি প্যালেস, চায়না কটকটি ঘর, আলাউদ্দিন কটকটি ভান্ডার, জিন্নাহ কটকটি ভান্ডার, ফাতেমা কটকটি প্যালেস, আল আমীন কটকটি প্যালেস, লায়েব কটকটি ভান্ডার, শাহাদত কটকটি ভান্ডার ইত্যাদি।

ব্যবসায়ীরা জানান, মহাস্থানগড়ের আশপাশে ছোট–বড় বহু কটকটি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ১০টি কারখানা বড় আকারের। এসব কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ১০০ মণ কটকটি তৈরি হয়।

দরদাম উপাদানের ভিন্নতার কারণে স্বাদ ও দামেও রয়েছে রকমফের। ব্যবসায়ীরা বললেন, মহাস্থানগড়ের দোকানগুলোতে বর্তমানে তিন ধরনের কটকটি বিক্রি হয়। এর মধ্যে সয়াবিন তেলে ভাজা কটকটি ৮০ টাকা, ডালডায় ভাজা কটকটি ১০০ টাকা এবং ঘিয়ে ভাজা কটকটি ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।

বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, যথাযথ নজরদারি ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বগুড়ার দইয়ের মতো মহাস্থানগড়ের কটকটির সুনামও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।