'অর্থ আছে, জীবন নেই'

ঢাকার উত্তরা থেকে তুরাগ নদ পার হলেই গাজীপুরের টঙ্গী। এটি গাজীপুরের সবচেয়ে পুরোনো শহর। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে যখন এই শহরের গোড়াপত্তন হয়, তখনো গাজীপুরের বেশির ভাগ এলাকা গহিন অরণ্য। এখন দেশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে একটি গাজীপুর। বন ধ্বংস, পরিবেশ ও পানিদূষণে এগিয়ে এই অঞ্চল। তবে কর্মসংস্থান, শিল্পায়নে এ অঞ্চলের অবদান অনেক বেশি।

মোটরসাইকেলে টঙ্গী থেকে গাজীপুর মূল শহরে আসতে সময় লাগে আধঘণ্টার মতো। কিন্তু রাস্তায় এত খানাখন্দ, ধুলা যে আধঘণ্টার সময়কে মনে হবে আড়াই ঘণ্টার মতো। 

শহরের ভাষাশহীদ কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক বললেন, গাজীপুরে একসময় বেশির ভাগ মানুষের পেশা ছিল কৃষি। মূলত শিল্পায়নের কারণে অনেকের পেশাও বদলে গেছে। আরও কয়েকজন বাসিন্দা বললেন, আর্থিক উন্নতি হলেও আগের মতো আর নির্মল পরিবেশ নেই, শান্তি নেই।

আকবর হোসেনের বয়স ৫০–এর কোঠায়। থাকেন কোনাবাড়ী এলাকায়। তিনি বলেন, তাঁর বাবার প্রায় ২০ বিঘা জমি ছিল। নব্বইয়ের দশকেও চাষাবাদ করতেন। এলাকায় শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে শুরু হলে জমির দাম বাড়তে থাকে, শ্রমিকদের থাকার জন্য ঘরের চাহিদা তৈরি হয়। তাই কিছু জমি বিক্রি করে টিনের ছাউনির বাড়ি করেন। এখন এই বাড়িভাড়াই তাঁর আয়ের মূল উৎস। তাঁর মতে, ‘কৃষির চেয়ে আয়ও বেশি, পরিশ্রমও কম।’ 

গত এক সপ্তাহে টঙ্গী, জয়দেবপুর, কোনাবাড়ী, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, মাওনাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মূলত ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ককে কেন্দ্র করে বেশির ভাগ শিল্পকারাখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় কাজ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন হাজার হাজার মানুষ। তাঁদের থাকা-খাওয়া, চলাচলসহ নানা চাহিদা মেটাতে গিয়ে বেড়েছে বসতবাড়ি, রাস্তাসহ নানান অবকাঠামো। আবার ঢাকার কাছে হওয়ায় অনেকেই জমি কিনে বসতি গড়েছেন গাজীপুরে। ফলে জমির ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে। 

গাজীপুরে ভূমির ব্যবহারের পরিবর্তন নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহসহ চারজন। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গাজীপুরে ‌‘বিল্টআপ এরিয়া’ (ভবনসহ অন্যান্য অবকাঠামোর জন্য ব্যবহার করা জমি) বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৬৫৪ শতাংশ। আর কৃষিজমি বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। একই সময়ে বনভূমি কমেছে প্রায় ৬২ শতাংশ এবং জলাভূমি কমেছে প্রায় ৫৪ শতাংশ।

>ভবনসহ অন্যান্য অবকাঠামোর জন্য ব্যবহৃত জমি বৃদ্ধির হার প্রায় ৬৫৪%
কৃষিজমি বেড়েছে প্রায় ৪০%
বনভূমি কমেছে প্রায় ৬২%
জলাভূমি কমেছে প্রায় ৫৪%


এ বিষয়ে গবেষক হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, বন কেটে কৃষিজমি তৈরি করা এবং কিছু ক্ষেত্রে পতিত জমিতে চাষ শুরু হওয়ার কারণে কৃষিজমি বেড়েছে। এটি চলতে থাকলে একসময় গাজীপুরে আর বন থাকবে না। 

গাজীপুর চেম্বার অব কমার্সের তথ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কারখানা রয়েছে। বেশির ভাগই পোশাক কারখানা। সিমেন্ট, রড, স্টিল ও ইলেকট্রনিক পণ্যের কারখানাও রয়েছে। দেশের মোট পণ্য রপ্তানি আয়ের (চার হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি) প্রায় এক–তৃতীয়াংশ আসে এসব কারখানা থেকে।

অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখলেও শিল্পকারখানাগুলো পরিবেশের ক্ষতি করছে বলে মনে করেন বাসিন্দারা। পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুর জেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুরে যেসব শিল্পকারখানা রয়েছে, তার মধ্যে ৪৮০টি কারখানা থেকে ক্ষতিকর তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এ জন্য কারখানাগুলোতে নিজস্ব বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ৩৫টি কারখানায় এমন শোধনাগার নেই। আবার যেসব কারখানার শোধনাগার আছে, সেগুলোরও একটা অংশ খরচ বাঁচাতে ইটিপি বন্ধ রাখে। এতে নদ-নদী, ফসলি জমি দূষিত হয়। আবার বায়ুদূষণ রোধে ১৬টি প্রতিষ্ঠানের এটিপি (এয়ার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ৫টি প্রতিষ্ঠানের এটিপি অকার্যকর। 

অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক আবদুস সালাম সরকার জানিয়েছেন, দূষণের প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১১৪টি দূষণকারী শিল্পকারখানাকে প্রায় ২ কোটি ৮১ লাখ টাকা জারিমানা করা হয়েছে। 

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড ঘেঁষে চিলাই নদ। নদের পারে কানাইয়া বাজারের বাসিন্দা আনোয়ার কাজী বলেন, ৮-১০ বছর আগেও এই নদের পানি মানুষ রান্নার কাজে ব্যবহার করত। এখন পানি থেকে গন্ধ আসে। কারখানার বর্জ্যের কারণে নদে মাছও হয় না। 

কানাইয়া থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে শিল্পসমৃদ্ধ ইটাহাটা এলাকা। গাজীপুর সদর হয়ে সেখানে যেতে চোখে পড়ল বড় বড় দালানকোঠা, লাখ টাকায় ফ্ল্যাট বিক্রির নোটিশ, আর কয়েক হাজার টাকায় ভাড়া থাকার বিজ্ঞপ্তি। ইটাহাটার বাসিন্দা আফাজ উদ্দিন (৬৮) বলেন, ‌‘একসময় নদ থেকে মাছ ধরে নিজেরা খাইতাম, বাজারেও বেচতাম। এহন মিলের পানিতে মাছ আর খাওন যায় না। পানিতে নামলে গায়ে (শরীর) চুলকায়। এহন ঘরভাড়া দিয়া আয় বাড়ছে। অর্থ আছে কিন্তু আগের মতন জীবন নাই।’