কিশোর গ্যাংয়ের 'বড় ভাই' টিনুর মাসিক আয় ৫০ লাখ টাকা

নুর মোস্তফা ওরফে টিনু
নুর মোস্তফা ওরফে টিনু

নগর যুবলীগের কোনো পদে নেই তিনি। কিন্তু দাপিয়ে বেড়ান যুবলীগ নেতা পরিচয়ে। তাঁর রয়েছে নিজস্ব ছিনতাইকারীর দল ও কিশোর গ্যাং। চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ, চকবাজার, বাকলিয়া ও কালুরঘাট এলাকায় তাঁর আধিপত্য। তিনি নুর মোস্তফা ওরফে টিনু।

শেষ রক্ষা হয়নি এই সন্ত্রাসীর। গত রোববার রাতে নগরের কাপাসগোলার বাসায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র, গুলিসহ টিনুকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। অভিযানে একটি পিস্তল ও শটগান এবং ৭২টি গুলি উদ্ধার হয়। গ্রেপ্তার করা হয় তাঁর সহযোগী জসিম উদ্দিনকে। এ ঘটনায় র‍্যাব মামলা করেছে। টিনুর গ্রেপ্তারে চকবাজার, বাকলিয়া এলাকায় স্বস্তি ফিরে আসে। র‍্যাবের দাবি, তাঁর ‘নিয়ন্ত্রণাধীন’ এলাকার ফুটপাত, কোচিং সেন্টার, শপিং মল ও টমটম (গাড়ি) থেকে সহযোগীদের মাধ্যমে মাসে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।

র‍্যাব-৭ চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) মিমতানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক, ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, ছিনতাই, অস্ত্র ব্যবসা ও কিশোর গ্যাং গড়ে তুলেছেন নুর মোস্তফা। ভয়ে ভুক্তভোগীরা কেউ মামলা করেন না।

র‍্যাব ও পুলিশ সূত্র জানায়, নগরের কাপাসগোলা এলাকার মৃত নুরনবীর ছেলে নুর মোস্তফার বিরুদ্ধে নগরের কোতোয়ালি, পাঁচলাইশ ও চকবাজার এলাকায় জমি দখল, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির অভিযোগে পাঁচটি মামলা রয়েছে। তবে কোনোটির সাজা হয়নি।

স্থানীয় সূত্র জানায়, পাঁচ বছর ধরে নুর মোস্তফার নামটি চট্টগ্রাম ও সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আলোচনায় উঠে আসে। চকবাজার এলাকায় নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে কলেজ দুটিতে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বহিরাগত ও কিছু ছাত্রকে নিয়ে প্রতিপক্ষ দল তৈরি করেন। তাঁর দলের সঙ্গে ছাত্রলীগের পাঁচ বছরে ১৫ বারের বেশি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, ছাত্রলীগকে কোণঠাসা করতে শিবিরের পক্ষ হয়ে তিনি কাজ করেন। কলেজ দুটির নিয়ন্ত্রণ যে দলের হাতে, এলাকাটিও তাদের কবজায়। 

টিনু যুবলীগের কেউ নন বলে দাবি করেন নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক দিদরুল আলম। তিনি বলেন, দলের নাম ভাঙিয়ে যারা চাঁদাবাজি করছে, তাদের বিচার হোক।

গতকাল দুপুরে চকবাজারের মুরগি, সবজি ও মাছ বিক্রেতা ক্ষুদ্র ১০ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, টিনুর ছেলেদের দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দিতে হয়। বাজারটি তাঁর অনুসারীরা ইজারা নিয়েছেন। দুই বছর আগে দৈনিক ৫০ টাকা করে দিতেন। এখন বাড়তি ১০০ টাকা হাসিলের নামে চাঁদা দিতে হচ্ছে। ছোট–বড় ৫০০ দোকান থেকে দৈনিক ৭৫ হাজার টাকা দেয়। 

কাঁচাবাজারের পাশেই টমটম গাড়ির স্ট্যান্ড। সেখান থেকে বাকলিয়া রাহাত্তারপুল ও আন্দরকিল্লায় যায় গাড়ি। প্রতিটি গাড়ি থেকে দৈনিক ৪০০ টাকা করে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ২০০ টাকা ভাগ নেন টিনুর সহযোগীরা। দুটি রুটে ১২০টি গাড়ি রয়েছে। গাড়িচালক রুস্তম আলী বলেন, চাঁদার কারণে বাড়তি টাকা দিতে হয়। 

চকবাজার এলাকার কয়েকটি কোচিং সেন্টার ও শপিং মলে গেলে তারা টিনুকে চাঁদা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু কেউ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

র‍্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, টিনু ফুটপাত, কোচিং সেন্টার, শপিং মল থেকে মাসে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার চাঁদা নেন। লাখ টাকা কারও কাছে দাবি করেন না, এই ছিঁচকে সন্ত্রাসী। 

টিনু তাঁর সহযোগীদের নিয়ে নীরব চাঁদাবাজি করার বিষয়টি শুনেছেন বলে জানান চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজাম উদ্দিন। তিনি বলেন, ভুক্তভোগী কেউ অভিযোগ না করায় ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।

কিশোর গ্যাংয়ে ২০০ সদস্য
স্কুল-কলেজপড়ুয়া ২০০ জনের কিশোর গ্যাং রয়েছে টিনুর। এ কারণে কিশোর গ্যাংদের ‘বড় ভাই’ তালিকায়ও তাঁর নাম রয়েছে। গত ৬ এপ্রিল নগরের গোলপাহাড় এলাকায় এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার বিষয় নিয়ে বাকলিয়া এলাকার কিশোরদের সংঘর্ষ হয়। ওই সময় কিশোরদের পক্ষ হয়ে টিনুর সহযোগী সাইফুল ইসলাম গোলপাহাড় থেকে কিশোরদের সঙ্গে যাওয়া মনিহারি ব্যবসায়ী লোকমান রনিকে গুলি করে হত্যা করেন। ঘটনার দুদিন পর পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সাইফুল নিহত হন।

চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ সব অভিযোগ অস্বীকার করে নুর মোস্তফা টিনু গতকাল র‍্যাব হেফাজতে পাঁচলাইশ থানায় ঢোকার আগে প্রথম আলোকে বলেন, সামনে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। তাঁর কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না। যুবলীগের কী পদে আছেন, জানতে চাইলে বলেন, সামনে কমিটি হলে অবশ্যই পদ পাবেন।