'কেজি মেপে' ঘুষ লেনদেন: তিতাসের সাবেক এমডিসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে ‘কেজি মেপে’ ঘুষ লেনদেনের ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে। তাই মামলার সিদ্ধান্ত হয়েছে তিতাসের সাবেক এমডিসহ চারজনের বিরুদ্ধে।

আজ বুধবার কমিশন মামলার অনুমোদন দেয় বলে জানান দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, শিগগিরই মামলা করবেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, তাঁরা হলেন তিতাসের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মীর মশিউর রহমান, গাজীপুর অঞ্চলের সাবেক ব্যবস্থাপক (বর্তমানে ব্যবস্থাপক, পাইপলাইন ডিজাইন বিভাগ) প্রকৌশলী ছাব্বের আহমেদ চৌধুরী, ছাব্বেরের স্ত্রী রুমানা রিসাত জামান ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসবি কনস্ট্রাকশনের মালিক মো. সাইফুল ইসলাম।

দুদক সূত্র জানায়, প্রথম আলো এবং আরও কয়েকটি গণমাধ্যমে ‘কেজি মেপে ঘুষ লেনদেন’ শিরোনামের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর অনুসন্ধানে নামে সংস্থাটি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, গাজীপুর জেলায় শিল্প ও ক্যাপটিভ সংযোগ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকটি অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে বেশি পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করছে। আবার অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে কম গ্যাস ব্যবহার করছে। ‘গ্যাস বিপণন নিয়মাবলি ২০১৪’ অনুযায়ী শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত লোড বা পরিমাণের চেয়ে বেশি গ্যাস ব্যবহার বা অনুমোদিত সরঞ্জামের অতিরিক্ত সরঞ্জাম ব্যবহার করা যাবে না। অনুমোদনের অতিরিক্ত লোড বা পরিমাণের চেয়ে বেশি গ্যাস ব্যবহার বা অনুমোদিত সরঞ্জামের চেয়ে বেশি সরঞ্জাম ব্যবহার করলে গ্যাস বিপণন নীতিমালা অনুযায়ী সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে।

অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, প্রকৌশলী ছাব্বের আহমেদ চৌধুরীর দায়িত্ব পালনকালে এ এ কার্স স্পান লিমিটেড, প্যারাগন পোল্ট্রি, আনোয়ার ইস্পাত, সিআরসি টেক্সটাইল,প্যানারোমা ওয়াশিংসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে বেশি গ্যাস ব্যবহার করার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে তিতাসের এমডি মীর মশিউর রহমানও নীরব ছিলেন। তিনিও অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহারকারী ভোগকারী গ্রাহক কিংবা গাজীপুরের ব্যবস্থাপক ছাব্বের আহমেদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। অনুসন্ধানে দুদক আরও দেখেছে, ওই সব অবৈধ কার্যক্রমের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছেন ঠিকাদার সাইফুল ইসলাম।

অভিযোগ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সাইফুল ইসলামের মালিকানাধীন এসবি কনস্ট্রাকশনের নামে ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংকের মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের শাখায় লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওই হিসাবে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল পর্যন্ত ১১ কোটি ১ লাখ ৭৬ হাজার ৯১৩ টাকা নগদে ও স্থানান্তরের মাধ্যমে জমা হয়েছে এবং তুলে নেওয়া হয়েছে। হিসাববিবরণী পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, হিসাবগুলোয় জমা–হিসাবে একেকটি চেক বা স্থানান্তর আদেশে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা জমা হয়েছে। এ বিষয়ে সাইফুল ইসলাম দাবি করেন, এটা তাঁর ব্যবসায়িক লেনদেন। কিন্তু তুলে নেওয়া টাকার সর্বশেষ গন্তব্যের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তিনি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসবি কনস্ট্রাকশন তিতাসের তালিকাভুক্ত ১.৩ শ্রেণির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্যাসের লাইন স্থাপন এবং গ্রাহকের সার্ভিস লাইন স্থাপন করে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল পর্যন্ত কোনো লাইন স্থাপনের কাজ করেনি। আবার তিতাসের কোম্পানির হিসাব থেকে তাঁর হিসাবে কোনো টাকা যায়নি। প্রতিষ্ঠানটি মূলত বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার সার্ভিস লাইন স্থাপনের কাজ করেছে। আর এ কাজে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জোনার বিপণন অফিস গাজীপুরের আওতাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নতুন সংযোগ বা লোড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঠিকাদার নির্বাচন করে দিয়েছেন জোনাল ম্যানেজার প্রকৌশলী ছাব্বের আহমেদ চৌধুরী। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মীর মশিউর রহমান, এসবি কনস্ট্রাকশনের মালিক সাইফুল ইসলামের সহায়তায় প্রকৌশলী ছাব্বের আহমেদ চৌধুরী ম্যানেজার হিসেবে তাঁর আওতাধীন এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নতুন সংযোগ বা লোড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন।

প্রকৌশলী ছাব্বের আহমেদ চৌধুরীর স্ত্রী রুমানা রিসাত জামানের মালিকানাধীন ওয়াস্ট কেম ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবটিতে ২৮ কোটি ৯৮ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭১ টাকা নগদে ও স্থানান্তরের মাধ্যমে জমা হয়েছে। নগদ ও স্থানান্তরের মাধ্যমে তুলে নেওয়া হয়েছে ২৮ কোটি ৬৬ লাখ ৮৫ হাজার ৪৩৬ টাকা। হিসাববিবরণী পর্যালোচনায় আর দেখা যায়, হিসাবগুলোয় জমা হওয়া টাকার অধিকাংশই জমা হয়েছে গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে। আরও দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওয়াস্ট কেমের কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই।

অনুসন্ধানের সার্বিক পর্যালোচনা করে দুদক বলছে, তিতাসের এমডি প্রকৌশলী মীর মশিউর রহমান, ঠিকাদার সাইফুল ইসলাম, প্রকৌশলী ছাব্বের আহমেদ চৌধুরী পরস্পর যোগসাজশে ৪০ কোটি ৩৬ হাজার ৫৮৪ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজেরা লাভবান হয়ে এবং অন্যকে লাভবান করে অবৈধভাবে ওই অর্থ অর্জন করেছেন। পরে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা গোপন বা ছদ্মাবৃত্ত করার কাজ করেছেন। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। সে কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা অনুমোদন করা হয়েছে।

অভিযোগটির অনুসন্ধান দলে ছিলেন উপপরিচালক মো. মনজুর আলম ও উপসহকারী পরিচালক মো. শাজাহান মিরাজ।