মিউজিয়াম অব রাজাস: যেখানে আছে হাসান রাজার স্মৃতি

ঘুরে ঘুরে হাছন রাজার ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখছেন দর্শনার্থীরা। গতকাল বিকেলে সিলেট নগরের জিন্দাবাজার এলাকায় ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’–এ।  ছবি: প্রথম আলো
ঘুরে ঘুরে হাছন রাজার ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখছেন দর্শনার্থীরা। গতকাল বিকেলে সিলেট নগরের জিন্দাবাজার এলাকায় ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’–এ। ছবি: প্রথম আলো

সিলেট ও সুনামগঞ্জে তাঁর বিশাল জমিদারি ছিল। কিন্তু এ পরিচয় ছাপিয়ে তিনি একজন মরমি কবি হিসেবেই দেশ-বিদেশে পরিচিত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত তাঁর গানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। সেই মরমি কবি হাসন রাজার ব্যবহৃত জিনিসপত্র আর স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন উপকরণের সমাহারে সাজানো হয়েছে ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’।

হাসন রাজার বর্ণাঢ্য জীবনের অনুসন্ধানে সিলেট নগরের জিন্দাবাজার এলাকায় অবস্থিত এই জাদুঘর দেখতে প্রতিদিনই ভিড় জমাচ্ছেন ঐতিহ্যপ্রেমী মানুষ।

গতকাল বুধবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেছে, জাদুঘরের ভেতরে হালকা শব্দে বাজছিল হাসনের লেখা গান ‘লোকে বলে, বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা না আমার’। গানের সুরে ভাসতে ভাসতে দর্শনার্থীরা হাসনের ব্যবহৃত জিনিসপত্র আর জাদুঘরে সাজিয়ে রাখা উপকরণ নিবিষ্ট মনে দেখছিলেন। কেউবা জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়কের কাছে খুঁজছিলেন হাসনকে নিয়ে মনের ভেতর জমিয়ে রাখা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর।

জাদুঘর সূত্রে জানা গেছে, নগরের জিন্দাবাজার এলাকায় নিজস্ব স্থানে ১৬ শতক জায়গা নিয়ে ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’ চালু করা হয়েছে। শিক্ষানুরাগী দেওয়ান তালেবুর রাজা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় ২০০৬ সালের ২৪ এপ্রিল জাদুঘরটি যাত্রা শুরু করে। এতে হাসন রাজার (১৮৫৪-১৯২২) পাশাপাশি বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন বাউল-ফকিরের স্মৃতিচিহ্নও প্রদর্শিত হচ্ছে। হাসন রাজার গানের পাণ্ডুলিপি, তাঁকে নিয়ে রচিত নতুন-পুরোনো বই ও গানের অডিও-সিডি, পৈতৃক বাড়ি ও মায়ের বাড়ির মাটি ও ইট, ব্যবহৃত চেয়ার, খড়ম ও শ্বেতপাথরের তৈজসপত্র, ইস্তিরি, হুক্কা, হাসনের ঘোড়ার লাগাম ও পায়ের কাঠ, দুর্লভ আলোকচিত্র, লোকবাদ্যযন্ত্রসহ নানা উপকরণ রয়েছে।

গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে জাদুঘরটি দেখতে এসেছিলেন নগরের উপশহর এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবদুল জলিল। তিনি প্রথম আলোকে জানান, প্রথমবারের মতো এ জাদুঘরে এসেছেন। জাদুঘর দেখে তাঁর ভালো লেগেছে।

আরও দুজন দর্শনার্থী জানান, জাদুঘরে হাসন রাজার পুত্রবধূ বেগম মেহেরজান বানুর ব্যবহৃত সোনা ও রুপার সমন্বয়ে প্রস্তুত করা পোশাক দেখতে ভালো লেগেছে। এ ছাড়া বংশপরম্পরায় হাসন রাজার ব্যবহৃত একটি লাঠি ও পুরোনো আমলের দুটি দৃষ্টিনন্দন সিন্দুক দেখতে পেয়ে তাঁরা চমৎকৃত হয়েছেন।

কয়েকজন দর্শনার্থী জানান, বিশ্বের ছোট কোরআন শরিফের একটি এই জাদুঘরে রয়েছে। ১৯৪৯ সালে হাসন রাজার জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ প্রাণের কথা গানে থেকে শুরু করে হালের প্রকাশিত বইগুলোও এ জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে। জমিদার হাসন রাজার জন্মমাটির পাশাপাশি এখানে তাঁর বাড়ির তৎকালীন প্রধান ফটকে থাকা দুটি সিংহের রেপ্লিকাও জাদুঘরে রয়েছে। 

সিলেটের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা প্রদীপ রঞ্জন বৈষ্ণব জাদুঘর দেখতে এসে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐতিহ্যের টানে এই জাদুঘরে আসি। স্ত্রী-ছেলেকে নিয়েও একাধিকবার এখানে এসেছি। হাসন রাজার অনেক গানের ভক্ত আমি। এখানে এসে যেন সেই হাসন রাজারই সংস্পর্শ পাই। হাসন রাজার ব্যবহৃত অনেক প্রাচীন ও দুর্লভ সামগ্রী জাদুঘরটির অন্যতম আকর্ষণ। সিলেটে পর্যটকেরা বেড়াতে এলে অনেকেই এ জাদুঘরে ঢুঁ মারেন।’

জাদুঘরসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, রোববার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিনই জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের জন্য সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকে। তবে প্রত্যেক দর্শনার্থীকে ২০ টাকার বিনিময়ে জাদুঘরে প্রবেশ করতে হয়। জাদুঘরের মূল উদ্যোক্তা হচ্ছেন হাসন রাজার বংশধর দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা।

জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর আহমেদ জানান, প্রতিদিন গড়ে অর্ধশতাধিক দর্শনার্থী জাদুঘরটিতে আসেন। এর বাইরে শুক্র ও শনিবার সিলেটে যখন পর্যটকদের ভিড় বেশি থাকে, তখন বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী হাসন রাজার সৃষ্টি ও জীবনকে জানতে জাদুঘরে আসেন। জাদুঘরে প্রাচীন বইপুস্তক ও হাসন রাজার ব্যবহৃত অনেক সামগ্রী থাকায়, অনেক গবেষকও এখানে নিয়মিত কাজ করতে আসেন।