ময়মনসিংহের নদ-নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে

দেখলে মনে হবে না এটি ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী সুতিয়া
দেখলে মনে হবে না এটি ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী সুতিয়া

খুব বেশি আগের কথা নয়, এই নদীতে সারা বছর নৌকা চলত, মাছ পাওয়া যেত, পানি টলটল করত। কিন্তু এখন বর্ষাকালে দুই–তিন মাস পানি থাকে। আর বাকি মাসগুলোতে পানি শুকিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন ধানের চাষ করেন, নয়তো কচুরিপানায় ভরা থাকে। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত সুতিয়া নদী দেখিয়ে কথাগুলো বলছিলেন স্থানীয় প্রবীণ তোতা মিয়া।

শুধু সুতিয়া নদীর অবস্থাই যে এমন তা নয়, ময়মনসিংহ জেলার কাঁচামাটিয়া, খীরু, কংস, নরসুন্দাসহ ছোট–বড় ৩৮টি নদীরই একই দশা। কোনোটা নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্বসংকটে, কোনোটা দূষণের কবলে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে, আবার কোনোটা দখলের কবলে সৌন্দর্য হারিয়েছে। বছরের পর বছর পলি জমে নদীগুলো প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। ব্রহ্মপুত্র নদে বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময় বেশ কটি স্থানে বড় বড় বালুচরের সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি ময়মনসিংহ শহরের তীর ঘেঁষে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র নদে সরকারিভাবে খননকাজ শুরু হয়েছে। ফলে আশা করা যাচ্ছে, ব্রহ্মপুত্র শিগগিরই তার হারানো রূপে ফিরে যাবে। নদকে ঘিরে মানুষের জীবনমানেও পরিবর্তন আসবে। কিন্তু জেলার অন্য নদীগুলোর ভাগ্যে এখন পর্যন্ত কোনো সুখবর জোটেনি। দখল, দূষণ আর নাব্যতা–সংকটে ধুঁকতে থাকা বিভিন্ন উপজেলার এসব নদী দিন দিন যেন মানচিত্রের বুক থেকে হারাতে বসেছে। তাই নদীগুলোকে রক্ষার তাগিদ দিয়েছেন পরিবেশবাদীরা।

নদীগুলোর এমন রুগ্‌ণ দশায় সাধারণ জনগণের জীবনমানেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কৃষিক্ষেত্রে ফসল চাষে ব্যাপক ভূমিকা রাখত এই নদীগুলো। কিন্তু নদীতে পানি না থাকায় ভূগর্ভস্থ কল স্থাপন করে পানির চাহিদা মেটাতে হচ্ছে কৃষকদের। মিঠাপানির মাছও দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে পানির অভাবে। অথচ এই নদীগুলোতে মাছ ধরার মাধ্যমে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পাশাপাশি দৈনন্দিন আমিষের চাহিদা পূরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত নদীগুলো। আর স্বল্প খরচে পণ্য পরিবহন ও যাত্রী চলাচলেও অনেক সুবিধা ছিল। কিন্তু এখন আর সে উপায় নেই।

মৃতপ্রায় নদীগুলোর মধ্যে খীরু নদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। ময়মনসিংহের ত্রিশাল, ভালুকা হয়ে গফরগাঁও উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত এই নদের পানি দূষণের কারণে কালচে হয়ে গেছে। দুর্গন্ধ ছড়ানোয় নদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুষ্কর। মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠছে। এই নদের পানি এতটাই বিষাক্ত যে এখন আর স্থানীয় লোকজনও এই নদে নামার সাহস করেন না। বেশ কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, কলকারখানার বর্জ্যে দূষিত এই খীরু নদের পানি ব্যবহার করলে শরীরে ঘা ও চুলকানি হয়।

এ ছাড়া ত্রিশালে সুতিয়া নদী এবং ময়মনসিংহ শহরে ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে বেশ কটি স্থানে অবৈধভাবে নদী দখল হতে দেখা গেছে। অতীতে নরসুন্দা আর রাজবাড়ী নদীকে মৃত হিসেবে চিহ্নিত করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। আর আয়মান, মালিজি, ভোগাই, হিংরাজানি প্রভৃতি নদী হারিয়ে যাওয়ার পথে। তবু এগুলো দেখার যেন কেউ নেই। মৃতপ্রায় নদীগুলোকে বাঁচানো না গেলে সাধারণ জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

হারিয়ে যেতে থাকা এই নদীগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য খননকাজ শুরু করে দখল ও দূষণরোধে প্রশাসনকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন ময়মনসিংহ শাখার সাধারণ সম্পাদক স্বাধীন চৌধুরী। আর পরিবেশ রক্ষা উন্নয়ন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শিব্বির আহমেদ নদীগুলোর এমন দুর্দশার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকেই দায়ী করেছেন।

ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান বলেছেন, নাব্যতা–সংকট দূরীকরণে ইতিমধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ শুরু হয়েছে। জেলার অন্য নদীগুলো ব্রহ্মপুত্র নদের শাখানদী। তাই ওই নদীগুলো ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহের ওপরই টিকে থাকত। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখে পলি জমে ভরাট হয়ে গিয়েছিল। তাই এখন খনন করে নদীটির প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে অন্য নদীগুলোতেও পানিপ্রবাহ আগের মতো বৃদ্ধি পাবে। আর নদী দখল ও দূষণ প্রতিরোধে জেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছে বলে জানান তিনি।