ক্যাসিনো-কাণ্ডে আ.লীগের দুই নেতার বিরুদ্ধে ৭ মামলা

এনামুল হক ও রূপন ভূঁইয়া
এনামুল হক ও রূপন ভূঁইয়া

গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এবং তাঁর ভাই থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রূপন ভূঁইয়া মতিঝিলের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবসহ রাজধানীর একাধিক স্থানে অবৈধ ক্যাসিনো চালিয়ে আসছিলেন। এসব ক্যাসিনো থেকে আয় করা কোটি কোটি অবৈধ টাকা, সোনা ও আগ্নেয়াস্ত্র আড়াল করতে ঘনিষ্ঠজন আবুল কালাম ও হারুন অর রশীদের বাসায় লুকিয়ে রাখেন। এঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সাত মামলায় এসব উল্লেখ করেছে র‍্যাব।

গত বুধবার রাত ও গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে র‍্যাব-৩–এর কর্মকর্তারা বাদী হয়ে সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া এবং ওয়ারী থানায় অস্ত্র, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও মানি লন্ডারিং আইনে এই সাত মামলা করেন। সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ওসি) মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

 গত মঙ্গলবার দুপুরে এনামুলদের বানিয়ানগরের ছয়তলা বাড়িসহ চারটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ টাকা, চার কোটি টাকার স্বর্ণালংকার ও ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে র‍্যাব। দুই ভাইয়ের সিন্দুক ভরে যাওয়ায় টাকা ও অলংকার তাঁরা ক্যাসিনোর কর্মচারী আবুল কালাম ও বন্ধু মো. হারুন অর রশীদের বাসায় রাখেন। র‌্যাব সেখান থেকেও টাকা ও স্বর্ণালংকার উদ্ধার করে। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের অংশীদার এনামুল ও রূপনের দৃশ্যমান ব্যবসা বলতে ছিল ক্যাসিনো। তবে এর সঙ্গে জড়িত কাউকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি র‍্যাব।

পুলিশ সূত্র জানায়, র‍্যাব সূত্রাপুর থানায় মানি লন্ডারিং ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি করে চারটি মামলা করে। ওয়ারী থানায় দুটি অস্ত্র আইনে এবং গেন্ডারিয়ার থানায় মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা করা হয়।

ওয়ারী থানায় করা অস্ত্র আইনের মামলায় বলা হয়, চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে র‍্যাব জানতে পারে, ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের অবৈধ ক্যাসিনোর অংশীদার এনামুল হকের অর্থ বিশ্বস্ত কর্মচারী আবুল কালাম ও হারুন অর রশীদের বাসায় আছে। র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ সোনা, আগ্নেয়াস্ত্র ও টাকা উদ্ধার করে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা মামলায় দুই ভাইকে আসামি করা হয়েছে।

দুই পুলিশ বরখাস্ত
মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনোতে অভিযানের সময় নেপালিদের পালাতে সহায়তা করার অভিযোগে পুলিশের দুই সদস্যকে বরখাস্ত করার কথা জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা শফিকুল ইসলাম। এঁদের একজন রমনা থানার কনস্টেবল দীপঙ্কর চাকমা, অন্যজন ডিএমপির প্ররক্ষা বিভাগের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) গোলাম হোসেন ওরফে মিঠু।

>

সূত্রাপুর থানায় মানি লন্ডারিং ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে চারটি, ওয়ারী থানায় অস্ত্র আইনে দুটি এবং গেন্ডারিয়া থানায় মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা।

১৮ সেপ্টেম্বর সেগুনবাগিচার একটি ভবনের সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর পুলিশের বিরুদ্ধে জুয়াড়িদের পালাতে সহায়তার অভিযোগ ওঠে। ওই দিন ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে র‌্যাবের অভিযানের পরই ক্যাসিনোর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। যুবলীগের বিভিন্ন নেতার নিয়ন্ত্রণাধীন এসব ক্যাসিনোতে নেপালিরা কাজ করতেন। এসব নেপালির কয়েকজন থাকতেন সামিট হাসান লজ নামের একটি বাড়িতে।

ওই বাড়ি থেকে পাওয়া সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, নেপালিরা ওই বাড়ি ছাড়ার আগে তিন ব্যক্তি সেখানে যান। তাঁদের একজনের হাতে ওয়াকিটকি ছিল। ওয়াকিটকি হাতে ওই ব্যক্তি সাদাপোশাকে থাকা পুলিশ সদস্য পরিচয় দেন। বিষয়টি গণমাধ্যমে এলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম তা নাকচ করে দেন। তিনি মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘তাঁরা যে পুলিশ সদস্য, এখন পর্যন্ত তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’

ডিএমপি কমিশনার গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে দুই পুলিশ সদস্যের আচরণ সন্দেহজনক দেখে তাঁদের বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁরা বোঝাতে চেয়েছেন, তাঁরা দায়িত্ব পালনের জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। এটা তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দুই পুলিশের সঙ্গে একজন গোয়েন্দা সংস্থার লোকও ছিলেন বলে তিনি জানান।

অবৈধ ক্যাসিনোয় এই দুই পুলিশ সদস্য ছাড়া আর কোনো পুলিশ সদস্য জড়িত আছেন কি না, এ প্রশ্নে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ক্যাসিনোয় যদি কেউ লাভবান হয়েও থাকেন, তাহলে যাঁদের মধ্যে লেনদেন হয়েছে, তাঁরা কেউ সেটা স্বীকার করবেন না। গোয়েন্দারা মাঠে কাজ করেছে, তাদের পূর্ণাঙ্গ চিত্র চাওয়া হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে হয়তো মামলা–মোকদ্দমা করা যাবে না, তবে প্রমাণ পেলে জড়িত পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ক্যাসিনোসহ অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এর আগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দুই সদস্যকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়েছে। এঁদের একজন পুলিশ পরিদর্শক এবং আরেকজন সহকারী উপপরিদর্শক।

শামীমের নমিনিদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ
যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের ব্যাংক হিসাবে যাঁরা নমিনি ছিলেন, তাঁদের সবার ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেছে বাংলাদেশ বাংক। এই নমিনিদের কয়েকজনের নামে টাকা রেখেছিলেন জি কে শামীম। সূত্র জানায়, জি কে শামীমকে গ্রেপ্তারের পরদিন এসব ব্যক্তি মোটা অঙ্কের চেক নিয়ে ব্যাংকে যান টাকা উত্তোলন করতে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ খবর জানার পরই জি কে শামীমের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন বন্ধ করে দেয়।

 শামীমের সঙ্গে যাঁদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে তাঁরা হলেন নওগাঁর দেলোয়ার হোসেন, গোপালগঞ্জের মুরাদ হোসেন, বাড্ডার জাহিদুল ইসলাম, যশোরের শহিদুল ইসলাম, ভোলার কামাল হোসেন, নীলফামারীর সামসাদ হোসেন ও বাগেরহাটের আমিনুল ইসলাম। পুলিশ এই সাতজনের নাম–ঠিকানা সংগ্রহ করেছে। এসব লোক কীভাবে শামীমের সঙ্গে যুক্ত হলেন, পুলিশ সেসবের হদিস করছে। তবে মনে করা হচ্ছে, নমিনির লোকেরা শামীমের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। শামীম তাঁদেরই নমিনি করেছিলেন।