কুষ্টিয়ায় পানিবন্দী ৩৫ গ্রামের মানুষ

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে বন্যায় দুই ইউনিয়নের ৩৫ গ্রামের মানুষ পানিবন্দী। গত বুধবার উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে বন্যায় দুই ইউনিয়নের ৩৫ গ্রামের মানুষ পানিবন্দী। গত বুধবার উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

চরাঞ্চলে সাধারণত আষাঢ়–ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বন্যা থাকে। সেই বন্যা মোকাবিলা ও ফসলের আবাদ নিয়ে আলাদা প্রস্তুতি থাকে। তবে এবার এই দুই মাসে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ও চিলমারী ইউনিয়নের চরাঞ্চলগুলোতে বন্যা দেখা দেয়নি। তবে হঠাৎ করে এই আশ্বিনে বন্যা দেখা দিয়েছে। 

কয়েক দিনের ব্যবধানে হুহু করে পদ্মার পানি বেড়ে যাওয়ায় পানি উপচে চরাঞ্চল প্লাবিত হয়। এতে ওই দুই ইউনিয়নের ৩৫ গ্রামের ৫০ হাজার বাসিন্দা পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৫ সেন্টিমিটার করে পানির উচ্চতা বাড়ছে। এতে চরম দুর্ভোগে আছে ওই বাসিন্দারা। মাঠের ফসল ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। এখনো সরকারি বা বেসরকারিভাবে ওই সব অঞ্চলে কোনো সাহায্য–সহযোগিতা মেলেনি। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, গত সাত দিনে পানির উচ্চতা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। পদ্মার বিপৎসীমা নির্ধারণ আছে ১৪ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার। সেখানে গতকাল শুক্রবার পানির উচ্চতা ছিল ১৩ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার, যা সর্তকবার্তা। 

কুষ্টিয়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পীযূষ কৃষ্ণ কুন্ডু প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ পানি বাড়ছে। এ সময়ে এর আগে এভাবে পানি বাড়েনি। আরও দু–এক দিন পানি বাড়ার পর কমতে পারে। উজানে বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় ভারত ফারাক্কা বাঁধের বেশির ভাগ গেট খুলে দেওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, আষাঢ়-ভাদ্র মাসের বন্যা না হওয়ায় তাঁরা অনেকটা আশ্বস্ত ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে ২০ সেপ্টেম্বর এলাকায় পানি প্রবেশ করতে থাকে। ধীরে ধীরে খেত তলিয়ে যেতে থাকে। একপর্যায়ে গত ছয় দিনে খেত ডুবে পানি ঘরের আঙিনায় ঢুকে পড়ে। গত বুধবার পর্যন্ত ওই দুই ইউনিয়নের অন্তত ৩৫টি গ্রাম পুরোপুরি পানিতে প্লাবিত হয়। এসব এলাকায় এখন একমাত্র চলাচলের বাহন নৌকা। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে বাসিন্দারা। দুই ইউনিয়নের সব কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। হাটবাজারেও পানি উঠে গেছে। বাড়ির ভেতরে ও আঙিনায় পানি প্রবেশ করায় পোকামাকড় ও সাপের উপদ্রব বেড়ে গেছে। 

গত বুধবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন নৌকায় ঘুরে বন্যার বিষয়টি সরেজমিন দেখা হয়। এ সময় মুন্সিগঞ্জ গ্রামের বাসিন্দা নৌকার মাঝি শওকত আলী বলেন, গত ৮–৯ বছরের মধ্যে এই সময়ে এত পানি বাড়া দেখা যায়নি। এবারই এই সময়ে পানি বাড়ায় সব ডুবে গেছে। তিনি নৌকায় করে কেনা খাবারসহ অনান্য জিনিস ডুবে যাওয়া বাড়ির বাসিন্দাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। 

সোনাতলা গ্রামে যেদিকে চোখ যায়, সব দিকে থই থই পানি। চারপাশের পানি, মাঝখানে টিনের চালা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফজলুল হক ও তাঁর স্ত্রী রসুনা খাতুন। বন্যার পানি বাড়ির ভেতর উঠে গেছে। দুই ছেলেমেয়েকে সমতলে নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়েছেন। তাঁর তিন বিঘা জমিতে মাষকলাই ছিল, বন্যায় সব ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। ছয় দিনে কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। কৃষকেরা বলেন, এক সপ্তাহ আগেও যেখানে সবুজ ফসলে ভরপুর ছিল, কয়েক দিনের বন্যায় এখন সেখানে থই থই পানি। তলিয়ে গেছে সব ফসল। তলিয়ে যাওয়া ফসলের অধিকাংশই মাষকলাইয়ের খেত। কিছু জমিতে রয়েছে বীজ পাট ও আমন ধান। সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, প্রতিবছর পদ্মায় বন্যার পানি বৃদ্ধি পেলেও মাষকলাই চাষের আগেই পানি জমি থেকে নেমে যায়। ফলে চরাঞ্চলে তাঁরা মাষকলাইয়ের চাষ করে থাকেন। কিন্তু এ বছর তেমন বন্যা না হওয়ায় তাঁরা ব্যাপকভাবে মাষকলাই চাষ করেছিলেন। হঠাৎ পদ্মার পানি বেড়ে যাওয়ায় কৃষকেরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। 

দৌলতপুর উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর দৌলতপুরে ২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে মাষকলাই চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও চাষ হয়েছে আরও বেশি জমিতে। লক্ষ্যমাত্রার শতকরা ৬৫ ভাগ মাষকলাই চাষ হয় চরাঞ্চলের চার ইউনিয়নে। এ বছরও সেখানে মাষকলাইয়ের আবাদ হয়েছে। 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বলেন, হঠাৎ বন্যায় অন্তত ১ হাজার ৩০০ হেক্টর জমির মাষকলাই নষ্ট হয়েছে। এতে প্রায় ১১ কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকেরা। ভবিষ্যতে তাঁদের বিশেষ সুবিধার আওতায় না নেওয়া হলে ক্ষতির মুখে থাকবেন তাঁরা। রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডল বলেন, ইউনিয়নের ১৯ গ্রামের মধ্যে ১৭টি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। তাঁদের সহযোগিতা করতে উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। 

এদিকে চিলমারী ইউনিয়নের ১৮টি গ্রামের সব কটি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সেখানে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। চিলমারী ইউপির চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমেদ বলেন, আকস্মিক বন্যায় তাঁর ইউনিয়নের চরের জমিতে চাষ করা প্রায় সব কৃষকের মাষকলাই ও আমন ধান তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকেরা। ইউনিয়নের ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। 

মঙ্গলবার বিকেলে দৌলতপুর ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজগর আলী রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও কৃষকদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। গত বুধবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এজাজ আহমেদও সরেজমিন বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে দেখেন।