পার্বত্য অঞ্চলের রাজকথন

চাকমা রাজার জন্য নতুনভাবে তৈরি করা প্রাসাদ। ছবি: লেখক
চাকমা রাজার জন্য নতুনভাবে তৈরি করা প্রাসাদ। ছবি: লেখক

ভৌগোলিকভাবে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার অবস্থান ছিল আসাম ও পার্বত্য ত্রিপুরা থেকে আরাকান ও মিয়ানমারের সীমান্ত পর্যন্ত। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ৫৯০ অব্দের ত্রিপুরা রাজা যুজা রুপার সময় থেকে ত্রিপুরা রাজশাসন শুরু হয়। এ অঞ্চলের আধিপত্য বারবার হাত বদল হয়। যুগে যুগে এ অঞ্চল শাসন করেছেন ত্রিপুরা রাজারা, আরাকানি, মুসলিম, মুঘল আর ব্রিটিশরা। ১৭৬০ সালে চট্টগ্রাম এলাকা মোগলদের কাছ থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে গেলেও পার্বত্য জনগোষ্ঠীর হেডম্যানদের কর্তৃত্ব বহাল রাখা হয়। ১৮২৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ কমিশনার স্বীকৃতি দেন যে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলো ব্রিটিশ প্রজা নয়—তারা কেবল করদাতা। ১৮৬০ সালে পার্বত্য অঞ্চলকে রেগুলেশন জেলা চট্টগ্রাম থেকে পৃথক করা হয়। পাহাড়ি এলাকাকে তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে অভিহিত করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সদর দপ্তর চন্দ্রঘোনায় স্থাপন করা হয়। ১৮৬৮ সালে চন্দ্রঘোনা থেকে রাঙামাটিতে জেলা সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয়। ১৯০০ সালে পার্বত্য অঞ্চলকে চাকমা, বোমাং ও মং সার্কেলে বিভক্ত করা হয় এবং প্রতিটি সার্কেলের চিফ নিযুক্ত করা হয়।

বর্তমানে রাঙামাটি জেলার বৃহত্তর অংশ ও খাগড়াছড়ি জেলার কিছু অংশ নিয়ে চাকমা সার্কেল, খাগড়াছড়ি জেলার বৃহত্তর অংশ নিয়ে মং সার্কেল এবং বান্দরবান জেলার বৃহত্তর অংশ ও রাঙামাটি জেলার কিছু অংশ নিয়ে বোমাং সার্কেল রয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চলের এই তিন সার্কেলপ্রধান স্থানীয় পাহাড়ি জনগণের কাছে রাজা হিসেবেই বিবেচিত। যদিও সরকারিভাবে তাঁদের সার্কেল চিফ বলা হয়। তবে তাঁরা স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে খাজনা আদায় করেন এবং সেই খাজনার অংশ যায় সরকারি খাতে।

খাগড়াছড়ি জেলা মং সার্কেলের অন্তর্গত। মারমা ও চাকমারাই সেখানে প্রধান জনগোষ্ঠী। চাকমা সার্কেলের প্রধান ‘চাকমা রাজা’। রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও রাজস্থলী উপজেলা নিয়ে চাকমা সার্কেল। চাকমারা সেখানে প্রধান জনগোষ্ঠী। বোমাং সার্কেল বান্দরবানে। এ সার্কেলের প্রধান হলেন ‘বোমাং রাজা’। বম বা বনযোগী আদিবাসীরা সেখানে প্রধান।

প্রতিবছর আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে রাজপুণ্যাহ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে খাজনা আদায় করেন তিন সার্কেলপ্রধান। তাঁরা আদায় করা খাজনার অর্থ জমা করেন পৃথকভাবে সরকার, রাজা ও হেডম্যানের অংশে। প্রতিটি সার্কেলের মৌজা হেডম্যান আছেন, তাঁরা পুণ্যাহ উৎসবের সময় সার্কেলপ্রধানের কাছে খাজনা দেন তরবারি সমর্পণের মাধ্যমে। তরবারি সমর্পণ আসলে রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যম—যেটি পালিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। তিন পার্বত্য অঞ্চলের তিন সার্কেলের তিন রাজার বর্তমান বাসস্থান দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। তারই কিছু স্মৃতি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি।

কামান ফতে খাঁ। ছবি: লেখক
কামান ফতে খাঁ। ছবি: লেখক


চাকমা রাজবাড়ি
গবেষকদের মতে, চাকমা রাজারা মুঘল আমলের অনেক আগ থেকে চাকমা জনগোষ্ঠীকে শাসন করে আসছিলেন। বিরাজ মোহন দেওয়ান চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত গ্রন্থে লিখেছেন, চম্পক নগর হচ্ছে চাকমাদের আদি ভূমি আর চাকমাদের আদি রাজার নাম সুধন্য। কিন্তু কোথাও কোথাও রাজা শাক্য রাজার নাম উল্লেখ আছে।
রাঙামাটি জেলার রাজবন বিহারের পাশেই কাপ্তাই লেক দিয়ে ঘেরা চাকমা রাজার রাজবাড়ি। বর্তমানে ৫১তম চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, তাঁর স্ত্রী ইয়েন ইয়েন ও মা আরতি রায় এ বাড়িতে থাকেন। রাজদরবার, কাছারি, সজ্জিত কামানের দেখা মিলবে এই কমপ্লেক্সে। আছে চাকমা সার্কেলের প্রশাসনিক দপ্তরও।

নৌকা থেকে জঙ্গলঘেরা একটা পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছিল আসলে কি কোনো বাসস্থান আছে ভেতরে? আসার আগে সবাই বলছিল, রাজার বাড়ি পুড়ে গেছে—দেখার কিছুই নেই। তবুও এসেছি এই আশায় যে রাজবাড়ির চত্বরে তো দাঁড়াতে পারব। কিছুদূর এগোনোর পর চোখে পড়ল কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ভ।

চাকমা রাজার বাড়ি মূলত ছিল চট্টগ্রামে। ১৮৭৩ সালে চাকমা রাজা হরিশচন্দ্রকে ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রামের রাজানগর ছেড়ে রাঙামাটিতে বাসস্থান পরিবর্তনের অনুরোধ করে। সেই থেকে চট্টগ্রামের রাজানগর থেকে চাকমা রাজবাড়ি স্থানান্তরিত হয় রাঙামাটিতে। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে রাঙামাটির চাকমা রাজবাড়িসহ ৫৪ হাজার একর আবাদি জমি প্লাবিত হয়।

বর্তমানে চাকমা রাজবাড়ি পুড়ে যাওয়ার কারণে পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে। পুরোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। শুধু রাজবাড়ি চত্বরে রয়েছে একটি ফতে খাঁ নামের ২৫০ বছরের পুরোনো কামান, যা চাকমা সৈন্যরা মোগলদের কাছ থেকে পেয়েছিল।

পুরোনো মং রাজবাড়ির নামুনা দেবী হল। ছবি: লেখক
পুরোনো মং রাজবাড়ির নামুনা দেবী হল। ছবি: লেখক


মং রাজবাড়ি
খাগড়াছড়ি জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান এটি। রাজার সিংহাসন, মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রত্নতাত্ত্বিক অনেক স্মৃতিবিজড়িত এই রাজবাড়ি। গেট দিয়ে ঢুকে প্রথমে মনে হচ্ছিল না যে কোনো রাজবাড়িতে ঢুকেছি। কিছুদূর যাওয়ার পর একতলা একটি দালান চোখে পড়ল। দেখা গেল মং রাজার লোগো লাগানো আছে সেখানে। কিন্তু অনেক দিন তার ওপরের ধুলা পরিষ্কার করা হয় না সেটা বোঝা যায়।

কথা বলার জন্য রাজার বংশধরদের খুঁজে পেলেও কেউ কথা বলতে রাজি হয়নি। প্রভাংশু ত্রিপুরার বই থেকে জানা যায়, কংজয়ের আমল থেকে মং সার্কেলপ্রধানদের যাত্রা শুরু। তৎকালীন ইংরেজ সরকার কংজয়কে ‘সোর্ড অব অনার’ প্রদান করে। বর্তমান নবম মং রাজা হিসেবে আছেন সাচিং প্রু চৌধুরী।

চতুর্থ মং রাজা নি প্রু চাইয়ের কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় তাঁর একমাত্র কন্যা নানুমাকে সহকারী মং চিফ হিসেবে নিয়োগ দেয় ব্রিটিশরা। তার নামে একটি কাছারি ঘর এখনো রাজবাড়ি চত্বরে বর্তমান। যদিও ভবনটির ভগ্নদশা। এর ভেতরে যাওয়ার পর সিলিংয়ে চোখ পড়তেই দেখা গেল কাঠের কারুকাজ এবং কাঠের ওপর আঁকা সুন্দর ছবি। তবে বহুদিন সংস্কার না করার চিহ্ন দেখা গেল সবকিছুর মধ্যে।

নামুনা দেবী হলের সিলিংয়ে আঁকা ছবি। ছবি: লেখক
নামুনা দেবী হলের সিলিংয়ে আঁকা ছবি। ছবি: লেখক


বোমাং রাজবাড়ি
রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার রাজার বাসস্থানের অল্প কিছু চিহ্ন খুঁজে পেলেও বান্দরবান রাজার কোনো কিছু খুঁজে পাইনি। এলাকাবাসী বলেছেন, বর্তমান ১৭তম বোমাং রাজা উ চ প্রু চৌধুরীর বাড়ি বান্দরবান শহরের জাদিপাড়ার সাঙ্গু হোটেল। ১৯৩৪ সালে ১৩তম রাজা একটি বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু সেটি ভেঙে ফেলা হয়েছে পারিবারিক কলহের কারণে।

আমিও যেমন বোমাং রাজার বাড়ি খুঁজেছি, দেশি-বিদেশি পর্যটকও তেমনি দেখতে চান বোমাং রাজবাড়ি। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত যাঁরা ভ্রমণ করেছেন খাগড়াছড়িতে, শোনা যায়, তাঁরা ১৪তম বোমাং রাজার রাজবাড়ি দেখতে পেয়েছেন।

পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার পাশাপাশি একবার রাজবাড়িগুলোও ঘুরে আসবেন সময় করে।