যে মেলার ঐতিহ্য ৩০০ বছরের

সাতক্ষীরার ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী গুড়পুকুরের মেলা। মেলায় আসছে সব বয়সের মানুষ। গতকাল দুপুরে শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে ।  ছবি: প্রথম আলো
সাতক্ষীরার ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী গুড়পুকুরের মেলা। মেলায় আসছে সব বয়সের মানুষ। গতকাল দুপুরে শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে । ছবি: প্রথম আলো

সাতক্ষীরার ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী গুড়পুকুরের মেলা জমে উঠেছে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলছে এ মেলা। প্রথম কয়েক দিন বৃষ্টির জন্য মেলা না জমলেও এখন মেলায় মানুষের উপচে পড়া ভিড়।

মেলায় আসছে সব বয়সের মানুষ। ১৯ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এ মেলা চলবে ১৫ দিন। মেলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সাতক্ষীরার কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, প্রতি বাংলা বছরের শেষ ভাদ্রে (পুরোনো পঞ্জিকা অনুযায়ী) হিন্দুসম্প্রদায়ের মনসাপূজা উপলক্ষে সাতক্ষীরায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে গুড়পুকুরের মেলা। শহরের পলাশপোল স্কুলের উত্তর-পশ্চিম কোণের বটতলায় হয় ওই পূজা। এই পূজাকে কেন্দ্র করেই ৩০০ বছরের আগে থেকে এ মেলা বসে আসছে। মেলাকে কেন্দ্র করে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সাতক্ষীরাবাসীর মিলনমেলায় পরিণত হয়ে ওঠে। আগে মেলা চলত অন্তত এক মাস ধরে। সারা দেশের ব্যবসায়ী ছাড়াও ভারতের কলকাতা থেকে ব্যবসায়ীরা আসতেন এ মেলায়।

সাতক্ষীরা পৌর কাউন্সিলর ফারাহ দীবা খান জানান, মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা দেড় শতাধিক দোকান বসেছে। মেলায় বসানো হয়েছে বিনোদনের জন্য নাগরদোলা। কাঠের সামগ্রী বসেছে প্রাণসায়ের খালপাড়ে। গাছের চারা নিয়ে বসেছেন নার্সারির মালিকেরা শহীদ কাজল সরণিতে। মেলায় গৃহস্থলী সামগ্রীসহ এমন কোনো জিনিস নেই, পাওয়া যাচ্ছে না।

মেলায় আসা শ্যামনগর বাদখাটের নাজমুন নাসরিন, হামিদা পারভিন জানান, তাঁরা প্রতিবছর মেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। গৃহস্থলী জিনিসপত্র অনেক কম দামে কেনা যায়। পাওয়া যায় সব ধরনের জিনিসপত্র।

তালার ধলবাড়িয়া এলাকা থেকে আবদুর রহমান বলেন, গাছের চারা কিনতে এসেছিলেন তিনি। এবার গাছের চারা অন্য বছরের তুলনায় কম উঠেছে।

কলারোয়া থেকে আসা নমিতা চৌধুরী জানান, ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে মেলা দেখতে ও কেনাকাটা করতে এসেছেন। মেলা উপলক্ষে দূরের আত্মীয়স্বজন এক সপ্তাহ আগে চলে এসেছেন তাঁদের বাড়িতে।

ঢাকা থেকে আসা ব্যবসায়ী রুহুল কদ্দুস ও আমজাদ হোসেন বলেন, ১৯ সেপ্টেম্বর মেলা শুরু পর থেকে বৃষ্টিতে এক সপ্তাহ মেলা জমেনি। দুই-তিন দিন আগে মেলা জমতে শুরু  হয়েছে। মেলার সময় ১৫ দিন, কিন্তু তা বাড়িয়ে এক মাস করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

সাতক্ষীরার সাবেক পৌর কমিশনার ও মুক্তিযোদ্ধা হাসনে জাহিদ বলেন, মেলাটি বন্ধের জন্য দীর্ঘদিন ধরে মৌলবাদী গোষ্ঠীরা চক্রান্ত করছিল। তারা মেলা শুরু হওয়ার আগেই প্রতিবছর শহরে মিছিল ও সভা-সমাবেশ করে মেলা বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করত। চক্রান্তের এই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মেলায় বোমা হামলা চালানো হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা রকসি সিনেমা হলে ও সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামের দ্য লায়ন সার্কাস প্যান্ডেলে পরপর দুটি শক্তিশালী বোমা হামলা চালানো হয়। ওই বোমা হামলায় দুজন ছাত্র ও একজন নারী চিকিৎসক নিহত হন। এ সময় আহত হয় শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। এরপর মেলা বসলেও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর মেলা বন্ধ হয়ে যায়। ২০১১ সালে স্থানীয় মানুষের দাবির মুখে ছোট কলেবরে মেলাটি আবার চালু হয়।

সাতক্ষীরা সুজনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ সরকার বলেন, সাতক্ষীরার ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে গুড়পুকুরের মেলা। মেলা যাতে আগের ঐতিহ্য ফিরে পায়, সে জন্য সব রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে মেলার স্থান সংকুচিত করে শুধু শহীদ রাজ্জাক পার্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ করায় মেলার জৌলুশ কমেছে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল ও পৌর মেয়র তাসকিন আহমেদ জানান, সাতক্ষীরা, তথা বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে মেলা শুরু করা হয়েছে। তবে এবার ডেঙ্গুর কারণে মেলা এক মাসের স্থলে ১৫ দিন চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মেলায় যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়, এ জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।