বন্দর জলসীমায় 'ভয়ানক' বিপদ

গত জুনে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে দুটি জাহাজের সংঘর্ষ হয়। ফাইল ছবি
গত জুনে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে দুটি জাহাজের সংঘর্ষ হয়। ফাইল ছবি

সাগরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের প্রধান এলাকা দিন দিন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় গত ১০ বছরে দুর্ঘটনায় পড়েছে ২৮৩টি জাহাজ। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে গত চার বছরে।

জাহাজমালিক ও নৌ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে চট্টগ্রাম বন্দর রুটে পণ্য পরিবহনে অনীহা দেখাবেন বিদেশি জাহাজ পরিচালনাকারীরা।

মেরিটাইম আইন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা আইনজীবী মহিউদ্দিন আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, কোনো বন্দরে দুর্ঘটনা বেশি হলে সেখানে চলাচলকারী জাহাজের বিমার প্রিমিয়াম বেড়ে যায়। আবার দুর্ঘটনার পর মামলা, জাহাজ আটকে থাকা, মামলা নিষ্পত্তিসহ অনেক কারণেই বাণিজ্যিকভাবে আর্থিক ক্ষতির শিকার হন জাহাজমালিকেরা।

সাগরে দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বড় জাহাজগুলো কুতুবদিয়া গভীর সাগরে রেখে পণ্য খালাসে খরচ বেশি। খরচ কমাতে পতেঙ্গা সৈকত বরাবর আলফা নোঙর এলাকায় জাহাজ এনে পণ্য খালাস করতে চান আমদানিকারকের প্রতিনিধিরা। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম গভীর এলাকায় বেশি গভীরতার জাহাজ এনে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব না হওয়ায় এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। বেশির ভাগ দুর্ঘটনায় একটি জাহাজের সঙ্গে আরেকটির সংঘর্ষ হচ্ছে। এ বিষয়টি দেখার দায়িত্ব বন্দর কর্তৃপক্ষের। কিন্তু বহির্নোঙরে দুর্ঘটনারোধে পদক্ষেপ শক্তভাবে কার্যকর করতে পারেনি বন্দর।

>

১০ বছরে ২৮৩ জাহাজ দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার কারণে বিমার প্রিমিয়াম বেড়ে পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়ার শঙ্কা।

বন্দর সূত্র জানায়, যেসব বড় জাহাজ (সাড়ে ৯ মিটার গভীরতার বেশি) বন্দর জেটিতে ভিড়তে পারে না, সেগুলো বহির্নোঙরে নোঙর করে রাখা হয়। এরপর লাইটার জাহাজে পণ্য স্থানান্তর করে খালাস করা হয়। এসব জাহাজে ৩০ থেকে ৬০ হাজার টন পণ্য থাকে। বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া পণ্যের ৬০ শতাংশই এভাবে বহির্নোঙরে খালাস করা হয়। সমুদ্রপথে দেশের ৯৩ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। ফলে এ বন্দরের ঝুঁকি দেশের আমদানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

দুর্ঘটনার কারণ

বন্দর ও জাহাজ কোম্পানিগুলোর তথ্যে দেখা যায়, বন্দরকেন্দ্রিক দুর্ঘটনার সিংহভাগই ঘটছে ‘আলফা নোঙর’ এলাকায়। এটি পতেঙ্গা সৈকত বরাবর সাগর এলাকা। বন্দরের তিনটি নোঙর এলাকার মধ্যে তুলনামূলক বেশি গভীর এ এলাকা। বড় জাহাজগুলো থেকে এখানেই পণ্য খালাস করা হয়। জাহাজের সংখ্যা বাড়তে থাকায় জায়গা না পেয়ে অনেক সময় বেশি ড্রাফটের (পানির নিচের অংশে জাহাজের দৈর্ঘ্য) জাহাজ কম গভীরতায় নোঙর করা হচ্ছে। এতে জাহাজের তলদেশ থেকে পানির তলদেশের দৈর্ঘ্য কমে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। গত চার বছরে গড়ে প্রতিবছর ৪৬টি জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়েছে।

বন্দরের একাধিক দুর্ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ফয়সাল আজিম। তিনি বলেন, কুতুবদিয়ায় পর্যাপ্ত পণ্য খালাস না করে বহির্নোঙরে এনে খালাস করার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। এখানকার স্রোতসহ সাগরের আচরণ সম্পর্কে ধারণা নেই বিদেশি জাহাজের ক্যাপ্টেনদের। ফলে নোঙর সরে গেলে তাঁরা জাহাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না।

এ অবস্থায় বন্দর কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা জানতে এখন উদ্‌গ্রীব বিদেশি জাহাজমালিকেরা। ১৭ সেপ্টেম্বর কুয়েত অয়েল ট্যাংকার কোম্পানির প্রতিনিধিরা বন্দর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছেন।

শক্ত পদক্ষেপ নেই

বন্দরে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় দুই বছর আগে জাহাজের বিমাকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো চট্টগ্রাম বন্দরগামী জাহাজের জন্য সতর্কতা জারি করে। এরপরই গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর বন্দরের নোঙর এলাকায় আসার সময় পাইলট নেওয়াসহ বেশ কিছু সুপারিশসহ নতুন আদেশ জারি করে বন্দর। গত বছরের ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর করার কথা থাকলেও তা হয়নি। পরে এ বছরের জুনে বন্দরের একটি কমিটি দুর্ঘটনা রোধে দেশীয় অভিজ্ঞ পাইলট নেওয়া বাধ্যতামূলক করা ও তদারকিসহ পাঁচ দফা সুপারিশ করে।

বন্দর পর্ষদের সদস্য (হারবার ও মেরিন) ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ শফিউল বারী প্রথম আলোকে বলেন, যেসব জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রথমবারের মতো এখানে আসবেন, তাঁদের জন্য পাইলট নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।

বন্দরের এসব পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন জাহাজমালিকেরা। দেশীয় জাহাজের মালিকানার সংখ্যায় শীর্ষ প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরের বহির্নোঙর এলাকায় এমনিতেই বাড়তি সতর্কতা নিতে হয়। এটি বিপজ্জনক নোঙর এলাকা হিসেবে বাইরে প্রচার করা হচ্ছে। এখন দুর্ঘটনা রোধে বন্দর যদি কোনো পদক্ষেপ নেয়, তা হবে দেশের জন্যই ইতিবাচক।