ক্যাম্পাস ছাড়লেন বঙ্গবন্ধু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য

বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। ছবি: প্রথম আলো
বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। ছবি: প্রথম আলো

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন রোববার রাতে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। রাত সাড়ে নয়টার দিকে উপাচার্য তাঁর আবাসিক ভবন থেকে নিজ গাড়িতে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। এ সময় তাঁর গাড়ির সামনে পুলিশের একটি গাড়ি ছিল।

উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে অধিকাংশ অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত কমিটি। এ কারণে তাঁকে উপাচার্যের পদ থেকে প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে ওই কমিটি।

ইউজিসির পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গতকাল সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহর কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গতকালই সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে ইউজিসি। এ খবর জানাজানির পর রাতে পুলিশি পাহারায় ক্যাম্পাস ছাড়লেন উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উপাচার্য ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়া সময় তাঁর গাড়ির সামনে পুলিশের একটি গাড়ি দেখা যায়। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা উপাচার্যবিরোধী স্লোগান দেন।

ইউজিসির সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ১১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে উপাচার্যকে প্রত্যাহার করা ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া কমিটি উপাচার্যের অনিয়ম, অদক্ষতা, দায়িত্বহীনতা ও অদূরদর্শিতা দেখতে পেয়েছে। কমিটি দেখতে পেয়েছে, বর্তমান উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালোভাবে চালাতে পারছেন না। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হলেও উপাচার্য মামলাসহ কোনো ব্যবস্থা নেননি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

ইউজিসির সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) দিল আফরোজা বেগম তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলতে রাজি হননি। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদনটি হাতে পাওয়ার পর সেটি দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

টানা দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগ, ভর্তি ও কেনাকাটা থেকে শুরু করে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কাজে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। এ ছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দমিয়ে রাখতে বহিষ্কার, অশোভন আচরণ, কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার ঘটনা নিয়েও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শুধু তা-ই নয়, উপাচার্যের মতো একটি সম্মানিত পদে থাকা খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির মতো গুরুতর অভিযোগ নিয়েও গণমাধ্যমে সংবাদ হয়েছে। এমনকি উপাচার্য তাঁর বাসভবনের কাছে একটি বিউটি পারলারের অনুমোদন দিয়েও আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। সবশেষ অভিযোগ হলো, প্রশাসনের নির্দেশে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়েছে, যার প্রতিবাদে তাঁরই প্রশাসনের দুজন সহকারী প্রক্টর পদত্যাগ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে গত ১১ দিন ধরে টানা আন্দোলন করে আসছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে ২৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসিকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক তথ্যাদি জানাতে অনুরোধ করে। এর পরদিন ২৪ সেপ্টেম্বর ইউজিসির সদস্য মুহাম্মদ আলমগীরকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন ইউজিসির সদস্য দিল আফরোজা বেগম ও মো. সাজ্জাদ হোসেন, ইউজিসির পরিচালক মো. কামাল হোসেন ও উপপরিচালক মৌলি আজাদ। কমিটি গঠনের পর দিন ২৫ সেপ্টেম্বর কমিটির সদস্যরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে সরেজমিনে যান। সেখানে দুই দিন সরেজমিনে কাজ করে তদন্ত কমিটি। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউজিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে এবং তাতে সত্য প্রতিফলিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১২ হাজার শিক্ষার্থীকে পড়ানোর মতো অবস্থা নেই। ক্যাম্পাসের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে তদন্ত কমিটি। 

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে
গোপালগঞ্জ থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধি জানান, উপাচার্যকে প্রত্যাহার করার সুপারিশের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেছেন, তাঁরা ইউজিসির সুপারিশকে স্বাগত জানান। কিন্তু এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, ‘প্রয়োজনে জীবন দেব, তবু উপাচার্য বিদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াব না।’

গতকালও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নানা স্লোগানে মুখর করে রাখেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। উপাচার্যের বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে লেখা প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন নিয়ে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। আন্দোলনের ১১তম দিনে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মো. বাবুল আজাদ। তিনি বলেন, উপাচার্যের ‘বাহিনী’ শিক্ষার্থীদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালায়। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যর কমিটি গঠন করা হলেও কোনো অগ্রগতি নেই। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর মো. বশির উদ্দিন বলেন, কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে টানা আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা।