স্টিয়ারিং হাতে স্বপ্নের যাত্রা

সরকারি উদ্যোগে গাড়ি চালনা শিখছেন কয়েকজন নারী। সম্প্রতি কালীগঞ্জ আরআরএন পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ থেকে তোলা।  ছবি: প্রথম আলো
সরকারি উদ্যোগে গাড়ি চালনা শিখছেন কয়েকজন নারী। সম্প্রতি কালীগঞ্জ আরআরএন পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

গাজীপুরের কালীগঞ্জ পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের দুর্বাটি গ্রামের বাসিন্দা রাইহানা ভূঁইয়া (৩৫)। স্বামী-সন্তানের দেখভাল করাই এই গৃহিণীর কাজ। তবে ছোটবেলায় তিনি অন্য রকম স্বপ্ন দেখতেন। ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে গাড়ি চালাবেন। নিজেই গাড়ি চালিয়ে সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন এত দিন পূরণ হয়নি তাঁর। তবে স্বপ্নের খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন তিনি। বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে তিনি গাড়ি চালানো শিখছেন। ভাবছেন গাড়ি কিনে হবেন নারী উদ্যোক্তা।

একই রকম চিন্তা করছেন কালীগঞ্জ শ্রমিক কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান (২২)। বড় হয়ে গাড়ি চালাবেন, এটা ছিল তাঁর শখ। তবে সেটা আয়ের উৎসও হতে পারে, এ চিন্তা করতে বেশি সময় লাগেনি তাঁর। তিনি মনে করেন, প্রতিযোগিতার এ যুগে নারী বলে কোনো কাজে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি এখন তিনি শিখে নিচ্ছেন গাড়িচালনা। ভাবছেন পড়াশোনা শেষে চাকরির অপেক্ষায় বসে না থেকে গাড়ি চালিয়ে স্বাবলম্বী হবেন। হাল ধরবেন সংসারের।

শুধু রাইহানা ভূঁইয়া, নুসরাত জাহানই নন। তাঁদের মতো একঝাঁক স্বপ্নবাজ নারী বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে শিখছেন গাড়িচালনা। এই নারীরা জীবনের কোনো না কোনো সময় গাড়ি চালানোর স্বপ্ন দেখতেন—হয় শখের বসে, নয়তো আয়ের উৎস হিসেবে। তাঁদের জন্য কালীগঞ্জে উপজেলা পর্যায়ে শুরু হয়েছে নারীদের আয়বর্ধক মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণটি হচ্ছে কালীগঞ্জ আরআরএন পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে। এখানে উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নারীদের শেখানো হচ্ছে গাড়িচালনা। এই নারীরা গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে যাত্রা করছেন স্বপ্নপূরণের পথে।

রাইহানা ভূঁইয়ার ভাষ্য, ‘এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শুধু যে স্বপ্নপূরণ হবে, তা নয়। এর মাধ্যমে নিজেই উদ্যোক্তা হতে পারব। সংসারে হাল ধরার সুযোগ তৈরি হবে।’ আর নুসরাত জাহান বলেন, ‘আমি কারও ওপর নির্ভরশীল হতে চাই না। বরং সংসারের দায়িত্ব নিতে চাই। কারণ, এখন ছেলে-মেয়ে সবাই সমান। ছেলেরা পারলে মেয়েরা পারবে না কেন। আমাদের শুধু দরকার সাহস।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারীদের আয়বর্ধক প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১৩ সেপ্টেম্বর এই মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে ব্যাচ আকারে। প্রতি ব্যাচে প্রশিক্ষণার্থী থাকেন ৩০ জন। ক্লাস হয় সপ্তাহে চার দিন। তিন মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণে মোট ক্লাস হবে ৬০টি। তিন মাস অন্তর নতুন ব্যাচ শুরু হয়। এ প্রশিক্ষণ নিতে কোনো টাকা লাগে না। বরং হাজিরা অনুসারে প্রশিক্ষণার্থীদের ১০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়া হয়। কেউ পুরো ৬০ দিন উপস্থিত থাকলে প্রশিক্ষণ শেষে ৬ হাজার টাকা পাবেন। সঙ্গে দেওয়া হবে একটি সনদ।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, কালীগঞ্জ আরআরএন পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠের এক পাশে বসে আছেন জনা বিশেক নারী। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কেউ গৃহিণী, কেউ চাকরিজীবী, কেউবা শিক্ষার্থী। মাঠের অন্য অংশে একটি প্রাইভেট কার দিয়ে গাড়িচালনা শেখাচ্ছেন এক প্রশিক্ষক। গাড়ির চালকের আসনে বসা আছেন একজন নারী। তাঁর পেছনের আসনে বসা আরও তিন নারী। সামনের আসনে প্রশিক্ষক চালককে প্রতিনিয়ত দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। সেসব শুনছেন পেছনে থাকা নারী প্রশিক্ষণার্থীরাও। এভাবে একজন একজন করে এই নারীদের গাড়ি চালানো শেখানো হচ্ছে। বাকিরা অপেক্ষা করছেন নিজের সিরিয়ালের।

প্রশিক্ষণে আসা অপেক্ষারত নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ প্রশিক্ষণে অংশ নিতে এসে তাঁদের সবাইকে কমবেশি বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। কখনো পরিবার, কখনোবা সমাজের অন্যরা বাধা দিয়েছেন। তবে সব বাধা অগ্রাহ্য করে গাড়িচালনা শিখতে এসেছেন তাঁরা। তাঁদের সবার লক্ষ্য স্বাবলম্বী হওয়া। পরিবারের দুঃখ দূর করা, সন্তান ও ভাইবোনদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা।

কান্তা (২৫) নামের এক নারী বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল নিজে কিছু করব। তা ছাড়া নারী গাড়িচালক হওয়াটা গর্বেরও বিষয়।’

শেফালি (২৮) নামের একজন বলেন, ‘মানুষ তো পিছে কথা বলেই, তাতে দুঃখ পেয়ে বসে থাকলে নিজেরই ক্ষতি।’

উপজেলার নারীবিষয়ক কর্মকর্তা শাহনাজ আক্তারের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘নারীদের গাড়িচালনার প্রতি প্রচুর আগ্রহ। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের কাজকর্ম সেরে সময়মতো ড্রাইভিং ক্লাসে উপস্থিত হন। আমরাও চেষ্টা করি তাঁদের পূর্ণাঙ্গ দক্ষ চালক হিসেবে গড়ে তুলতে। এতে তাঁরা ভবিষ্যতে আত্মনির্ভরশীল হতে পারবেন।’ 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিবলী সাদিক বলেন, প্রতিটি ব্যাচে ৩০ জন করে থাকলেও আবেদন পড়েছে অসংখ্য। তাঁদের মধ্য থেকে বাছাই করে এই কজনকে নেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে নারীদের ভীষণ আগ্রহ দেখছেন বলে তিনি জানান।