ঝিনাইদহের ছিমছাম পাড়ায় ডেঙ্গুর হানা

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

নবম শ্রেণির ছাত্রী রাবেয়া খাতুন শ্রেণিকক্ষে থাকতেই জ্বর অনুভব করে। বাসায় ফিরে কয়েক দিন জ্বরে কাতরায়। কমার লক্ষণ নেই দেখে হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষার পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর। সন্তানের শুশ্রূষায় ব্যস্ত মা শেফালি বেগমও অসুস্থ হয়ে পড়েন। দুই দিন বাদে তাঁরও ডেঙ্গু ধরা পড়ে। একই দশা ছেলে আসিফ হোসেনের।

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত পরিবারের তিন সদস্যকে নিয়ে দিশেহারা অবস্থা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের একতারপুর গ্রামের মণ্ডলপাড়ার রমজান আলীর। হাসপাতাল আর বাড়িতে দৌড়াদৌড়িতেই তাঁর দিন কাটছে। পরিবারের একমাত্র সুস্থ সদস্য তিনি। নিজে হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিবারে কী ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে, সে আশঙ্কায় রমজান। তিনি জানালেন, কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন ছিল পরিবারের সদস্যরা। স্ত্রী-কন্যা কিছুটা সুস্থ হয়েছে। তবে ছেলের স্বাস্থ্যের উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই।

মণ্ডলপাড়ায় ডেঙ্গুর হানা শুরু হয়েছে প্রায় তিন সপ্তাহ আগে। ইতিমধ্যে পাড়ার অন্তত ২২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। বেশির ভাগই চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। একটি শিশু এখনো খুলনা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা ও বানুড়িয়া গ্রামে ইতিমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানান চিকিৎসকেরা। তাঁরা হলেন বানুড়িয়ার সুফিয়া বেগম এবং বালিয়াডাঙ্গার তারানা বেগম।

ঝিনাইদহ সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে কালীগঞ্জ উপজেলার একতাপুর গ্রাম। যেতে হয় বাসে এবং ব্যাটারিচালিত রিকশায়। আড়াই শতাধিক পরিবারের বাস ওই গ্রামে। এর মধ্যে মণ্ডলপাড়ায় ১০২টি পরিবার থাকে। ডেঙ্গুর মূল ধাক্কা এই পাড়াতেই। অন্তত ১৫টি পরিবারে ডেঙ্গুর হানা পড়েছে। ছিমছাম শান্ত এই পাড়ায় হুট করে ডেঙ্গুর প্রকোপে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ইউনিয়নে।

গত রোববার মণ্ডলপাড়া ঘুরে জানা যায়, দুই সপ্তাহ ধরে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই কৃষক পরিবারের সদস্য। অনেকে কয়েক মাসের মধ্যে ঢাকায় যায়নি। হুট করে ডেঙ্গুর প্রকোপের কারণ সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। তবে আশঙ্কা করছেন, ঝোপঝাড়ে, গর্তে কিংবা বাড়ির আঙিনায় জমে থাকা বৃষ্টির পানি থেকে এডিস মশার বিস্তার হতে পারে। ডেঙ্গু রোগী বাড়ার পর পাড়াজুড়ে পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু হয়েছে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী এবং তাদের স্বজনেরা বলেন, কম সময়ের মধ্যে এত মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পরও ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কম। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে দুই দিন ওষুধ ছিটানো হয়েছে। প্রথম দিন ওষুধ ছিটাতে এলে মশকনিধনকর্মীদের যন্ত্র নষ্ট হয়ে যায়। পরে আরেক দিন এসে ওষুধ ছিটিয়েছেন। তবে তা খুবই সামান্য। নিজেদের উদ্যোগে বাসিন্দারা তাঁদের বাড়ির আঙিনায় পোকামাকড় মারার ওষুধ ছিটিয়েছেন। এতে কতটুকু সুফল আসবে, তা তাঁরা নিশ্চিত নন।

প্রায় দিনই নতুন কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। এই ভয়ে ওই পাড়ার সাগর হোসেন চৌগাছায় শ্বশুরবাড়ি ছিলেন সপ্তাহখানেক। পরে ফিরে আসেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। বাড়িতে আসার পরই শরীরে জ্বর অনুভব করেন। এরপর হাসপাতালে গেলে ধরা পড়ে তাঁর ডেঙ্গু হয়েছে। সাগর হোসেন জানান, তিনি আক্রান্ত হওয়ার দুই দিন বাদে তাঁর মা চম্পা বেগমও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁরা এক সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

ওই পাড়ার জালাল মণ্ডল জানান, জ্বর দেখা দিলে হাসপাতালে যান। সেখানে দেড় হাজার টাকা খরচ করে পরীক্ষায় তাঁর ডেঙ্গু ধরা পড়ে ৯ সেপ্টেম্বর। তিনি জানান, তাঁর আরেক ভাই মোশারফ হোসেন মণ্ডল প্রথমে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ভাই মোশারফ হোসেনের ডেঙ্গু ধরা পড়ে ৩ সেপ্টেম্বর। পাঁচ দিন পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে ছেলে বিপুল হোসেনের।

অহেদ আলীর স্ত্রী নূরী বেগম আক্রান্ত হয়েছেন ২২ সেপ্টেম্বর। পুত্রবধূ নার্গিস বেগম জানান, তাঁর শাশুড়ির জ্বর হলে প্রথমে পল্লিচিকিৎসকের কাছে যান। পরে অবস্থা আরও খারাপ হলে যান কালীগঞ্জ শহরের হাসপাতালে। সেখানে পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। দুই দিন ভর্তি থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। বর্তমানে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।

কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা হুসাইন সাফায়াত জানান, তাঁরা এখন পর্যন্ত অন্তত ২২ জন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দিয়েছেন। এ ছাড়া প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো হয়েছে।

ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা বেশ কয়েকবার ওই পাড়ায় ওষুধ ছিটিয়েছেন। পরিচ্ছন্নতা অভিযান করেছেন। তারপরও কেন এমন হচ্ছে, তা বুঝতে পারছেন না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবর্ণা রানী সাহা বলেন, বিষয়টি জানার পর তিনি ওই এলাকার ইউপি সদস্যকে প্রধান করে তাঁরা একটি কমিটি করেছেন। যারা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা কাজে সবাইকে সচেতন করার কাজ করছে। ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।