খালেদা জিয়ার জামিনে সরকারের আনুকূল্য চায় বিএনপি

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। দেশে বা বিদেশে তাঁর উন্নত চিকিৎ​সার প্রয়োজন মনে করছে বিএনপি। কিন্তু আইনি পথে বারবার আটকে যাচ্ছে এই চেষ্টা। এখন দলীয় প্রধানের জামিনে সরকারের আনুকূল্য চায় বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, জামিনে বড় বাধা সরকার। তাই সরকার ও রাষ্ট্রপক্ষ নমনীয় হলে খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পেতে পারেন। 

জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টে দুর্নীতির যে দুটি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ১৭ বছর কারাদণ্ড হয়েছে, ওই দুটিতেই তাঁর জামিন আবেদন হাইকোর্টে নাকচ হয়েছে। এখন তা আপিল বিভাগে যাবে। কিন্তু সেখানেও যদি সরকার বা রাষ্ট্রপক্ষ অনমনীয় অবস্থান নেয়, তাহলে খালেদা জিয়ার জামিন চূড়ান্তভাবে আটকে যেতে পারে। সে জন্য নতুন করে জামিনের আবেদন নিয়ে আপিল বিভাগে যাওয়ার আগে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় বিএনপি।

এ লক্ষ্যে দলের সাতজন সাংসদ গত দুই দিনে দুই দফায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎ​সাধীন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ​ করেন। গতকাল বুধবার জি এম সিরাজসহ চারজন সাংসদ এবং আগের দিন হারুনুর রশীদসহ তিনজন সাংসদ দলীয় প্রধানের সঙ্গে দেখা করেন। ফিরে এসে তাঁরা অসুস্থ খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্তি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। 

 গতকাল জি এম সিরাজের নেতৃত্বে চার সাংসদ খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংসদ নেতা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার কাছে আমাদের সবিনয় অনুরোধ, আপনি খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। আপনি আমলাতান্ত্রিক পরামর্শ না নিয়ে দয়া করে রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় আমাদের নেত্রীকে ছেড়ে দিন, জামিনের ব্যবস্থা করে দিন।’

এর মধ্যে গতকাল দুপুরে সাংসদ হারুনুর রশীদ সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করেন। আগের দিন তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, খালেদা জিয়া আজকে জামিন পেলে কালকেই বিদেশে যাবেন। 

হারুনুর রশীদের বক্তব্যের রেশ ধরে গতকাল দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জামিন পেলে খালেদা জিয়া বিদেশে যাবেন, এ কথা বিএনপির যে সদস্য (সাংসদ হারুনুর রশীদ) বলেছেন, তিনি আমার সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। আমাকেও একই কথা বলেছেন। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকেও জানাতে বলেছিলেন। আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি।’ কাদের বলেন, প্রশ্ন হচ্ছে তিনি জামিন পাবেন কি না, সেটা আদালতের বিষয়। সরকার আদালতকে কীভাবে বলবে যে জামিন দিয়ে দেন? এটা কি বলা উচিত?

তবে ওবায়দুল কাদের এ-ও বলেন, ‘উনি (খালেদা জিয়া) যদি জামিন পান এবং চিকিৎসকেরা যদি মনে করেন তাঁর বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করা দরকার, সেটা তাঁরা বলতে পারেন। সে ধরনের কোনো রিপোর্ট পেলে, চিকিৎসকদের পরামর্শ থাকলে জানাতে পারেন। আদালতে জামিন দেওয়ার বিষয়ে সরকার বলতে পারে না। এটি আদালতের ওপর ছেড়ে দিন।’

সংবাদ সম্মেলনের পর সাংসদ হারুনুর রশীদ এলাকার একটি কাজের বিষয়ে ওবায়দুল কাদেরের কাছে যান। ফিরে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘নেত্রীর জামিনের বিষয়টি সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করার জন্য বলে এসেছি। ওনার (খালেদা জিয়া) শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ এবং তাঁর দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।’

দুর্নীতির দুই মামলায় দণ্ড নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে রয়েছেন। ৭৪ বছর বয়সী খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য গত ১ এপ্রিল থেকে বিএসএমএমইউতে আছেন। বিএনপির নেতারা বলছেন, বার্ধক্য ও নানা ধরনের অসুস্থতায় খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। জামিন না পাওয়াটা তাঁর জন্য খুবই অমানবিক একটি ব্যাপার।

সুপ্রিম কোর্ট ও নিম্ন আদালত মিলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এখন ১৭টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে দুটি মামলায় (জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা) জামিন পেলেই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেতে পারেন বলে তাঁর আইনজীবীদের ভাষ্য।

এত অসুস্থতার মধ্যেও খালেদা জিয়ার জামিন না হওয়ার বিষয়টিকে খুবই দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে আদালতের ব্যাপার আছে বটে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের সবকিছুই তো নিয়ন্ত্রিত। সরকারের উচিত হবে তাঁর বয়স এবং শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় যতটুকু সদয় হওয়া উচিত, ততটুকু হওয়া।’ 

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া ১০ বছরের সাজার রায় স্থগিত এবং জামিন চেয়ে গত ১৪ মার্চ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল করেন খালেদা জিয়া। আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া সাত বছরের সাজা ও অর্থদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদা জিয়া। এই আপিল গত ৩০ এপ্রিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন হাইকোর্ট। আপিল শুনানির জন্য গ্রহণের পর জামিন চেয়ে খালেদা জিয়ার আবেদন গত ৩১ জুলাই হাইকোর্টে খারিজ হয়। পরে হাইকোর্টের অপর একটি দ্বৈত বেঞ্চে এই জামিন আবেদন উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু গত ১১ সেপ্টেম্বর এই জামিন আবেদন ফিরিয়ে নেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। এখন আইনজীবীরা আপিল বিভাগে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

হঠাৎ​ করে পরপর দুই দিনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিএনপির সাত সাংসদের সাক্ষাৎ​, একই সঙ্গে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আরেক সাংসদের দেখা করার পর নতুন করে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। যদিও কিছুদিন আগেও একবার প্যারোলে অর্থাৎ সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি নিয়ে খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়। যদিও বিএনপি তা নাকচ করে দিয়ে বলেছে, তারা প্যারোল নয়, জামিনে মুক্তি চান। আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, প্যারোলের আবেদন পেলে তাঁরা বিবেচনা করবেন। 

প্যারোলের বিষয়টি নিয়ে আবারও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে গতকাল খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানান বিএনপির নারী সাংসদ রুমিন ফারহানা। তিনি বলেন, ‘আমি সরাসরি প্যারোলের বিষয়ে ম্যাডামকে বলেছিলাম। ম্যাডাম বলেছেন, “দেশের আইন অনুযায়ী আমি এখনই জামিন লাভের যোগ্য, আমি কোনো অপরাধ করিনি, সুতরাং প্যারোলের প্রশ্ন কেন আসবে?”’

খালেদা জিয়ার সঙ্গে দলীয় সাত সাংসদের সাক্ষাৎ নিয়েও দলের ভেতরে–বাইরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।​ এই সাক্ষাতের পেছনে সরকারের হাত আছে কি না বা সাংসদেরা সমঝোতার কোনো বার্তা নিয়ে গিয়েছিলেন কি না, তা নিয়েও জল্পনাকল্পনা আছে। যদিও বিএনপির সাংসদেরা কোনো রকমের সমঝোতার কথা নাকচ করে দিয়েছেন।

এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘কোনো বিষয়ে ধারণা তৈরি করাটা আমাদের মানুষজনের একটা সহজাত স্বভাব, সত্য-মিথ্যাটা পরে। এখানে সমঝোতার কী আছে। আমরা সব সময় বলে আসছি, এসব মামলায় তিনি জামিন পাওয়ার যোগ্য। জামিন পাওয়াটা তাঁর প্রাপ্য। তাঁকে আটক করে রাখা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। সরকারের উচিত তাঁর প্রাপ্যটা দেওয়া।’

বিএনপির নেতারা বলছেন, সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে আইনি পথে খালেদা জিয়ার জামিন পাওয়া আর সম্ভব নয়। খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। সে জন্যই তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইছেন।

এ বিষয়ে সাংসদ জি এম সিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া কি ম্যাডামের মুক্তি হবে? আজকে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট বিব্রতবোধ করেন তাঁর জামিনের বিষয়ে। আমাদের নেত্রী রাজনৈতিক বন্দী। আমরা বিশ্বাস করি, এখানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার।’

রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে যে কথাবার্তা চলছে, তা বোঝা গেল একজন মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই মন্ত্রী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি এখন হিংসাত্মক রাজনীতি করছে না। তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করছে। এ জন্য তাদের বিভাগীয় সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার বিষয়েও সরকার এখন কিছুটা নমনীয়।