দারিদ্র্যের কশাঘাতে পিষ্ট একেকজন শিক্ষার্থী যখন তাদের জীবনযুদ্ধের কথা বলছিল, তখন মিলনায়তনজুড়ে পিনপতন নীরবতা। আগত অতিথিদের অনেকেই হয়েছেন আবেগাপ্লুত।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ব্র্যাক ব্যাংক ও প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে আয়োজিত অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের জীবনের গল্প শোনাচ্ছিল। অদম্য মেধাবী বৃত্তি পাওয়া সুনামগঞ্জের ধরমপাশার জেলে পরিবারের মেয়ে মুক্তা দাসের মনে গল্পটি দাগ কেটে যায়। তার এমনও দিন গেছে, খিদে মিটাতে কেবল খুদ (চালের ভাঙা ও গুঁড়া অংশ) খেয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হয়েছে। এখন অবশ্য সে সুনামগঞ্জের কলেজে পড়ছে। তার ভাষায়, এখন প্রথম আলো ট্রাস্ট ও ব্র্যাক ব্যাংক তার স্বপ্ন পূরণে বড় ভূমিকা রাখছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এনামুল হক নিজে যেমন মানুষের দোকানে কাজ করেছে, তেমনি তার মাকে মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু প্রতিকূলতার মধ্যেও দমে যায়নি। এসএসসিতে ভালো ফল করে এখন সে ঢাকার উত্তরার একটি কলেজে পড়ছে। তবে এখন আর পড়ালেখার জন্য আর্থিক সমস্যা নেই তার। কারণ, তার পাশে দাঁড়িয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক ও প্রথম আলো ট্রাস্ট।
অনুষ্ঠানে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী বৃত্তি পেয়ে স্নাতক পাস করা ৪৩ জনকে ক্রেস্ট, এইচএসসির পর স্নাতক পর্যায়েও বৃত্তি পেতে যাওয়া ২৭ জনকে মেডেল ও এসএসসির পর এইচএসসিতে বৃত্তির জন্য নির্বাচিত হওয়া ৭১ জনকে উপহারসামগ্রী দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে মুক্তা দাস ও সাব্বির ছাড়াও অনুষ্ঠানে নিজেদের কথা তুলে ধরেন চট্টগ্রামের পটিয়ার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী মো. সাইফুদ্দিন রাফি, কক্সবাজারের মহেশখালীর শাহিন সুলতানা, কক্সবাজারের পারভেজ মোশারফ, রংপুরের জান্নাতুল ফেরদৌসী।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যেমন কষ্টের কথা ছিল, তেমনি ছিল সাফল্য ও আনন্দের কথাও। অদম্য মেধাবী ছাড়াও শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, বিনোদনের জগতের তারকা, ক্রিকেটাররাও উৎসাহমূলক বক্তৃতা করেন। ছিল নৃত্যানুষ্ঠান, সংগীত ও জাদুর অনুষ্ঠান।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম অদম্য মেধাবী বৃত্তির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৯৪২ জনকে এই বৃত্তি দেওয়া হয়। ব্র্যাক ব্যাংক ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবেও প্রথম আলো ট্রাস্টে সহায়তা করেন অনেকে।
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর এফ হোসেন উপস্থিত অদম্য মেধাবীদের ভালোবাসা জানিয়ে বলেন, ‘আজ আপনাদের আনন্দের দিন, সামনে তাকানোর মুহূর্ত। ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিষদ ও বোর্ড এই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পেরে আনন্দিত ও গর্বিত।’ তিনি বলেন, ব্র্যাক ব্যাংকের অন্যতম ভিশন হচ্ছে আলোকিত বাংলাদেশ গড়ায় ভূমিকা রাখা। অদম্য মেধাবীরা আলোকিত বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করছেন।
অদম্য মেধাবীদের উৎসাহ দিতে এসেছিল সুযোগ-সুবিধায় এগিয়ে থাকা ঢাকার ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয় সানিডেইল, স্কলাস্টিকাসহ কয়েকটি বিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থী। তারা দাঁড়িয়ে ও করতালি দিয়ে অদম্য মেধাবীদের অভিবাদন জানায়।
অদম্য মেধাবী বৃত্তি নিয়ে চিকিৎসক হওয়া মাসুদ রানা তাঁদের মতো অদম্য মেধাবীদের সহায়তা ও সাহস দেওয়ার জন্য প্রথম আলো ট্রাস্টকে ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রায় ১০০ বছর আগে তাঁর কৃষক পরিবারের বাবা কীভাবে সকালে গরু চরিয়ে ও দুধ বাজারে বিক্রি করে স্কুলে লেখাপড়া করতেন এবং মাধ্যমিকে মেধা তালিকায় স্থান পান, সেই কথাও তুলে ধরেন। তাঁর বাবাও এই অদম্য মেধাবীদের মতো বৃত্তি নিয়ে কলকাতায় পড়তে যান। অদম্য মেধাবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, গ্রামকে, সমাজকে ভুলে যাওয়া যাবে না।
অদম্য মেধাবীদের পড়াশোনার ইচ্ছাশক্তির প্রসঙ্গে টেনে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ট্রাস্টি অধ্যাপক পারভীন হাসান বলেন, বাইরের কেউ যদি সহায়তার হাত ধরে, তাহলে অদম্য মেধাবীদের পথচলার চেষ্টা সহজ হয়ে যায়।
সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উপাচার্য এ এন এম মেশকাত উদ্দিন বলেন, ‘যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখলাম আজ।’
এ ধরনের কাজে সরকারি সহায়তার প্রতি মুখাপেক্ষী না হয়ে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন আইইউবিএটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুর রব।
অনুভূতি ব্যক্ত করেন ব্যক্তিগতভাবে ১০ জন অদম্য শিক্ষার্থীকে সহায়তা দেওয়া ডা. শিরিন আখতার।
বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন ‘অদম্য মেধাবীদের জন্য আমার বুকভরা ভালোবাসা তৈরি হয়। আমরা বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই। সমগ্র ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে চলেছে। এ ধরনের অদম্য মেধাবী, যারা দরিদ্র, নিগৃহীত, সবচেয়ে বেশি অধিকারবঞ্চিত, তারা যখন জেগে ওঠে, তারা যখন সামনে এগিয়ে যাবে, তখন সত্যিকার অর্থে বলব বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। আমরা বলব বাংলাদেশের জয় আসছে।’
অনুষ্ঠানে অদম্য মেধাবীদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ার জন্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুল সানিডেইলের পক্ষ থেকে ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকার চেক ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর এফ হোসেনর হাতে তুলে দেন সানিডেইলের উপাধ্যক্ষ জেবুন্নেছা মাহমুদ।
প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ জামান চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন চিত্রনায়ক সিয়াম আহমেদ, ক্রিকেটার শাহরিয়ার নাফীস, টেন মিনিটস স্কুলের উদ্যোক্তা আয়মান সাদিক, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, প্রথম আলো ট্রাস্টের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আজিজা আহমেদ প্রমুখ। অদম্য মেধাবীদের নিয়ে গঠন করা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় অনুষ্ঠানে।
শেষে জাদু দেখান রাজীব বসাক এবং সংগীত পরিবেশ করে ব্যান্ড দল চিরকুট।