বাংলাদেশের উদ্বেগ ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন বিল

নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: বাসস
নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: বাসস

ভারত বারবার আশ্বস্ত করায় আসামের নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে বাংলাদেশ এখন আর ততটা উদ্বেগে নেই। কিন্তু বাংলাদেশের গলার কাঁটার মতো খচখচ করছে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল। ভারতের শাসক দল এখন চাইছে, আসামসহ সারা দেশে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার আগে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ফেলতে। এই আইন সংশোধন হলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ‘অত্যাচারিত-বিতাড়িত’ সংখ্যালঘুদের ভারতের নাগরিকত্ব লাভ সহজতর হয়ে যাবে।

সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এনআরসি নিয়ে তাঁকে ভারতের আশ্বস্ত করার কথা বৃহস্পতিবার নিজেই জানান। নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে এদিন সন্ধ্যায় এক অনুষ্ঠানে এনআরসি নিয়ে ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমাকে বলেছেন, এনআরসি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। বলেছেন, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’

একই কথা এর আগে ঢাকা সফরে গিয়ে বলেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির কথায় তিনি (বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) আশ্বস্ত ও সন্তুষ্ট কি না? জানতে চাওয়া হলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অবশ্যই সন্তুষ্ট। প্রধানমন্ত্রী (মোদি) নিজে আশ্বাস দিয়েছেন। আমি কেন তা হলে অন্য কিছু ভাবব?’

এনআরসি নিয়ে ভারতের বরাভয় দান বাংলাদেশকে নিশ্চিন্ত করলেও বন্ধু এই প্রতিবেশী দেশের দুশ্চিন্তা বাড়ছে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে।

সম্প্রতি বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ কলকাতায় বলেন, সারা দেশে এনআরসি চালু করা তো হবেই, তার আগে সংশোধন করা হবে নাগরিকত্ব আইন।

একই কথা শুনিয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবতও। নাগরিকত্ব নিয়ে কোনো হিন্দুকে যাতে অনিশ্চয়তায় পড়তে না হয়, তাঁরা যাতে নাগরিকত্ব পান, ভারত সরকার তা নিশ্চিত করবে।

বিজেপির উদ্দেশ্য, এনআরসিতে নাম না-ওঠা অ-মুসলমান ‘বিদেশিদের’ ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া।

প্রস্তাবিত সংশোধনীর লক্ষ্য—২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যেসব হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জৈন ও পার্সি ভারতে চলে এসেছেন, ৬ বছরের অপেক্ষা শেষে তাঁরা সবাই ভারতের নাগরিক হতে পারবেন।

বাংলাদেশের সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী একাধিক কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের অনুষ্ঠানে নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের বিষয়ে তাঁদের উদ্বেগের কথা জানান।

একান্ত আলাপচারিতায় এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এই আইন সংশোধিত হলে সেটা বাংলাদেশের কাছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর দুর্বৃত্তদের আক্রমণ নেমে আসতে পারে। ভারতের বোঝা উচিত, তাদের এই পদক্ষেপ মৌলবাদী শক্তিদের উৎসাহিত করবে। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।’

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অন্য এক সফরসঙ্গী কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ সদা সচেষ্ট। বিদেশি বাছাইয়ের নামে কিছু মুসলমানকে যদি বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়, তার একটা প্রতিক্রিয়া দেশের অভ্যন্তরে পড়লেও পড়তে পারে। তেমন হলে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র রক্ষা হয়ে দাঁড়াবে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং।’

এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশের সংখ্যালঘু জনসংখ্যা বাড়তির দিকে। তাঁরা সবাই বাংলাদেশকে নিরাপদ বলে ভাবতে শিখেছেন। এই ধরনের (প্রস্তাবিত সংশোধনী) গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আঞ্চলিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি ভারতের নজরে রাখা জরুরি।

সফররত বাংলাদেশি কর্মকর্তারা অবশ্য মনে করেন, ভারতের আইন-আদালত এই উদ্যোগকে (নাগরিকত্ব সংশোধন বিল) মান্যতা দেবে না। ধর্মের আধারে নাগরিকত্ব প্রদান ভারতের সংবিধানবিরোধী বলেই গণ্য হবে।

বাংলাদেশ হাইকমিশনে বৃহস্পতিবারের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুঝিয়ে দেন, পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলে ‘বাংলা’ করার প্রস্তাবটি তাঁর পছন্দের নয়।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে নাম পরিবর্তনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। রাজ্য বিধানসভা সর্বসম্মত প্রস্তাব কেন্দ্রকে পাঠিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বারবার আরজি জানাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে তাঁর অপছন্দের কথা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ রয়েছে। বাংলা নাম হলে আবার ব্যাপারটা অন্য রকম হয়ে যাবে। তা ছাড়া ওয়েস্ট বেঙ্গলের তো আলাদা একটা ঐতিহ্য আছে। বিশ্বে পরিচিতি আছে। নাম বদলে গেলে সেই পরিচিতির কী হবে? আলাদাভাবে ওয়েস্ট বেঙ্গলকে কীভাবে চিনবে?’

বৃহস্পতিবারের সান্ধ্য আয়োজনে শেখ হাসিনা একটা ‘ব্রেকিং নিউজও’ দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, যেদিন থেকে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছে, সেই দিন থেকে তিনিও কোনো রান্নায় পেঁয়াজ খাচ্ছেন না।

কাকতালীয়ভাবে যেদিন বাংলাদেশ থেকে প্রথম দফায় ২৫ টন ইলিশ পশ্চিমবঙ্গে ঢোকে (দুর্গাপূজা উপলক্ষে মোট ৫০০ টন আসবে), সেদিনই ভারত সাময়িকভাবে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। শেখ হাসিনা হাসতে হাসতে বলেন, ‘পেঁয়াজ ছাড়াই রান্না করতে বলেছি। যেদিন দাম কমবে, সেদিন থেকে ফের পেঁয়াজ খাব।’