এক দশকে ৬৮ লাখ মানুষ ঘরবাড়িছাড়া

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রাকৃতিক দুর্যোগে গত ১০ বছরে দেশের এক–চতুর্থাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত হয়েছে। এই এক দশকে দুর্যোগের কারণে ঘরবাড়িছাড়া হয়েছে অন্তত ৬৮ লাখ মানুষ। বন্যা ও ঝড়ের মতো দুর্যোগ তো আছেই, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শৈত্যপ্রবাহ থেকে শুরু করে ভূমিধসের কারণেও বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্ষতির শিকার হচ্ছে। সুইডেনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা রাউল ওয়ালেনবার্গ ইনস্টিটিউট (আরডব্লিউআই) এবং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) এক যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গত সপ্তাহে গবেষণা প্রতিবেদনটি আরডব্লিউআইয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

‘দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুতি: আইন ও নীতি সুরক্ষা’ শীর্ষক গবেষণাটি মোট ১০টি দেশের ওপরে করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ও দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতুর ওপরে করা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে বলে সংস্থার সূত্রে জানা গেছে। গবেষণা করা অন্য দেশগুলো হলো চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন ও নেপাল।

এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুল আউয়াল খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তুচ্যুত মানুষের অধিকারের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে দেশের কোনো আইনে উল্লেখ আছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি জলবায়ুবিষয়ক বৈশ্বিক আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু তাদের অধিকারের বিষয়টি দেখভালের জন্য দেশে যথেষ্ট আইনি কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা নেই। এটি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

গবেষণা প্রতিবেদনে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আঘাত হানা সাত ধরনের দুর্যোগকে আমলে নেওয়া হয়েছে। এই সময়ে আঘাত হানা মোট ৫১টি বড় দুর্যোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘূর্ণিঝড় আইলায়। ২০০৯ সালে প্রলয়ংকরী ওই ঘূর্ণঝড়েই ১৩ লাখ ৪২ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর সবচেয়ে বেশিবার যে দুর্যোগটি বাংলাদেশে আঘাত করেছে, সেটি হচ্ছে বন্যা। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে মোট ১৬ দফা বন্যা হয়েছে। এতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ২ কোটি ২৬ লাখ ৫৬ হাজার ৪০৭। 

>

গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫১টি বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে
গত ১০ বছরে ১৬ দফা বন্যা
আক্রান্ত ২ কোটি ২৬ লাখ ৫৬ হাজার ৪০৭ জন
ঘূর্ণিঝড় আইলায় ১৩ লাখ ৪২ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত

গবেষণা প্রতিবেদনের বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. শাহ্ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছরই বন্যা, নদীভাঙন ও ঝড়ের কারণে বিপুল পরিমাণে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে এটা ঠিক। তবে এসব মানুষকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার পুনর্বাসন করছে। বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় তাদের সহযোগিতা দেওয়া। একই সঙ্গে যাতে কোনো মানুষ বাস্তুচ্যুত না হয়, সে জন্য দুর্যোগ–সহনশীল ঘর করে দিচ্ছে সরকার।

গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতির আলোকে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের অধিকার কী অবস্থায় আছে, তার একটি পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২ তে বাস্তুচ্যুত মানুষের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। সরকারের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক কর্মপরিকল্পনা ও কৌশলপত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগ বেড়ে যাচ্ছে এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বলে উল্লেখ আছে। কিন্তু এসব বাস্তুচ্যুত মানুষের অধিকার কীভাবে সুরক্ষিত হবে, তার কোনো উল্লেখ নেই। এমনকি দেশে প্রতিবছর কী পরিমাণ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, তার কোনো হিসাবও নেই।

প্রতিবেদনে সুপারিশ হিসেবে বাংলাদেশের বাস্তুচ্যুত মানুষের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি স্বতন্ত্র সংস্থা গঠন করার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বাস্তুচ্যুত মানুষের আইনি সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করতে একটি আলাদা আইন করার কথা বলা হয়েছে। দেশের জনগণ সংবিধানে যেসব অধিকার ভোগ করে, বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোকেও একই ধরনের অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

গবেষণা প্রতিবেদনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের পরিমাণ বাড়ছে, সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়তে পারে। ফলে যারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাদের সুরক্ষা ও অধিকার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে সরকারের কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে।